Tuesday, April 22, 2025

রবীন্দ্রনাথ এর কাছে ‘রাখীবন্ধন’ ছিল প্রীতির বন্ধন, মানব বন্ধন

- Advertisement -

ভারতীয় পরিবেশে রাখীবন্ধনের পিছনে রয়েছে বহুল প্রচলিত কিছু পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনী। পূর্বে উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, রক্ষাবন্ধন থেকেই সূত্রপাত ঘটেছে রাখীবন্ধনের। পরে রবীন্দ্রনাথ মানব বন্ধন রক্ষার্থে শুরু করেন রাখীবন্ধন উৎসব। তিনিঅবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে মানবিকতা, সম্প্রীতি, একতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ ফুটিয়ে তুলতে দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে পালন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।


রবীন্দ্রনাথ 1

‘রাখীবন্ধন’ বলতে বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্প্রীতির বার্তাকেই স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু এই রাখীবন্ধনের পিছনে আছে বহুল প্রচলিত পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনী। পৌরাণিক কাহিনী ‘যম ও যমুনা’ মতে, যমুনা নামে এক বোন তার ভাই যমের হাতে রাখী বেঁধে দেয় ভাইয়ের মঙ্গল কামনায়। ‘শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রৌপদী’ কাহিনী অনুসারে, কৃষ্ণের হাতের আঙুল কেটে গেলে দ্রৌপদী তার গাত্রবস্ত্র ছিঁড়ে বেঁধে দেয় কৃষ্ণের আঙুলে। আবার ‘লক্ষ্মী ও বানররাজ বালি’ কাহিনী মতে, ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মী এক হতদরিদ্র মহিলার ছদ্মবেশে বালির কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করলে বালি তার প্রাসাদের দরজা খুলে দেয় ও দেবী লক্ষ্মী খুশি হয়ে বালির হাতে কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেয়। এই দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা। অপর এক কাহিনী ‘সন্তোষী মা’ অনুসারে, শুভ ও লাভ নামে গণেশের দুই পুত্র তাদের বোনের হাতে রাখী পরতে চাইলে নিরুপায় হয়ে ঋদ্ধি ও সিদ্ধি নামে দুই স্ত্রীর অন্তর থেকে সন্তোষী মাকে নির্গত করে, যে তাদের রাখী পরিয়েছিল।

বহুল প্রচলিত ঐতিহাসিক কাহিনী ‘হুমায়ূন ও রানী কর্ণবতী’ অনুসারে, মেওয়ারের রানী কর্ণবতী শত্রুর হাত থেকে নিজরাজ্য রক্ষা করতে মোগল সম্রাট হুমায়ূনের সাহায্য প্রার্থনা করে একটি রাখী পাঠিয়েছিল। ‘পুরু ও রোক্সানা’ কাহিনী অনুসারে, গ্রীক সম্রাট আলেকজাণ্ডার ও পুরুর যুদ্ধের পূর্বে আলেকজাণ্ডারের স্ত্রী রোক্সানা তার স্বামীকে হত্যা না করার আর্জি জানিয়ে পুরুকে রাখী পাঠিয়েছিল, যদিও সেই যুদ্ধে পুরু পরাজিত হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাখীকে রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে এবং এই রক্ষাবন্ধন থেকে রাখীবন্ধনের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রাখীবন্ধন এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কর্মসূচি ও হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জুলাই ২০, ১৯০৫ সাল। তৎকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক উত্তাল সময়। ব্রিটিশ ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জন প্রস্তাব ঘোষণা করে বঙ্গভঙ্গের। অখণ্ড বাংলাকে (তখন বাংলা, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, তেহট্ট নিয়ে ছিল অখণ্ড বাংলা) শোষণ করা যে দুরূহ তা উপলব্ধি করে তাই ভরসা করতে হয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের উপর। কারণ, এই সময় অবিভক্ত বাংলা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। ঠিক হয় ‘ডিভাইড এণ্ড রুল’ নামে ভেদনীতির মাধ্যমে ধর্মের উপর ভিত্তি করে বাংলাকে ভাগ করা হবে, হিন্দু জনসংখ্যার আধিক্যযুক্ত অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে পৃথক করা হবে।

দিনটি ছিল ১৬ আগস্ট, বাংলা শ্রাবণ মাস। কাকতালীয়ভাবে সেই দিনটি ছিল রাখীপূর্ণিমা। রবীন্দ্রনাথ এর মাথায় আসে এক অন্য রকম রাখীবন্ধনের। তাঁর ডাকে প্রতিবাদে সামিল হন জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাংলার মানুষ। ১৭ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ কলকাতার সাবিত্রী লাইব্রেরি স্বধর্ম সমিতির এক বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে প্রস্তাব রাখেন, ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ (বাংলা ৩০ আশ্বিন) ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ আইনের কার্যকারিতা রদ করতে বাঙালি সেদিন অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে ও ঐক্য বজায় রাখতে দেশ জুড়ে রাখীবন্ধন পালন করবে। উপকরণ হিসেবে থাকবে হরিদ্রা বর্ণের তিন সুতোর রাখী এবং মন্ত্র হবে ‘ভাই ভাই একঠাঁই, / ভেদ নাই, ভেদ নাই’।

- Advertisement -

রাখীবন্ধনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে মানবিকতা, সম্প্রীতি, একতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ ফুটিয়ে তুলে দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে পালন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাজনীতিকরা কলকাতা শহরে হরতাল আহ্বান করেছিলেন। রাখীবন্ধন উৎসব উপলক্ষে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু’ গানটি। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ‘…ঠিক হ’ল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখী পরাব। এই সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানে যাব— রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। … রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে। রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে— মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম— যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও (দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ) ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল— ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’…। (ঘরোয়া, পৃ. ২৮-২৯)।

রবীন্দ্রনাথ ৯ অক্টোবর ১৯০৯ সালে (২৩ আশ্বিন ১৩১৬) শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক অজিতকুমার চক্রবর্তীকে শান্তিনিকেতনে কিভাবে রাখী উৎসব উদ্‌যাপন করা উচিত সে বিষয়ে এক চিঠিতে লেখেন, ‘যে রাখীতে আত্মপর শত্রুমিত্র স্বজাতি বিজাতি সকলকেই বাঁধে, সেই রাখীই শান্তিনিকেতনের রাখী।… আমরা কষ্ট পেয়ে দুঃখ পেয়ে, আঘাত পেয়ে সর্বস্ব হারিয়েও সকলকে বাঁধব, সকলকে নিয়ে এক হব— এবং একের মধ্যে সকলকেই উপলব্ধি করব। বঙ্গবিভাগের বিরোধ ক্ষেত্রে এই যে রাখীবন্ধনের দিনের অভ্যুদয় হয়েছে এর অখণ্ড আলোক এখন এই ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে সমস্ত ভারতের মিলনের সুপ্রভাত রূপে পরিণত হোক…।’ (বিশ্বভারতী পত্রিকা, অগ্রহায়ণ ১৩৪৯, পৃ. ৩০০-৩০২)।

এর চার দিন পর, ২৭ আশ্বিন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে রাখীসংগীত পাঠিয়ে লেখেন, ‘প্রভু, আজি তোমার দক্ষিণ হাত / রেখো না ঢাকি। / এসেছি তোমারে, হে নাথ / পরাতে রাখি’। (গীতাঞ্জলি ৪৩, স্বরবিতান ৪৭)।

রাখীবন্ধন আর শুধুমাত্র ভাই-বোনের প্রীতির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলে। পরিণত হয় এক মহান উৎসবে। রবীন্দ্রনাথ এর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘রাখীবন্ধন’ ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। রবীন্দ্রনাথ পরিকল্পিত রাখীবন্ধন কর্মসূচি তৎকালীন জাতীয় আন্দোলনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ শাসকরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এই রাখীবন্ধনের ফলস্বরূপ মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বাধ্য হন বাংলা ভাগ রদ করতে, ১৯১১ সালে।

বর্তমান উৎসব রীতি অনুসারে, বাঙালি বোন বা দিদি শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় ভগবানের কাছে তার ভাই বা দাদার মঙ্গল কামানায় তাদের হাতে রাখী বা পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমানে অনেকাংশে রাখীবন্ধন সামাজিক ও ধর্মীয় গণ্ডী অতিক্রম করে রাজনৈতিক পরিসরে প্রবেশ করেছে। অবাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে এটা রক্ষাবন্ধন নামেও পরিচিত। উত্তর ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উৎসব ভাই-বোন ছাড়াও নিকটাত্মীয় ও জ্ঞাতির মধ্যেও প্রচলিত আছে। ২৪ আগস্ট ১৯৫৩, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁর নতুন দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে রাখীবন্ধন উদ্‌যাপন করেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ পরিকল্পিত বিদ্যালয়েও শুরু হয় রাখীবন্ধন উদ্‌যাপন। এখনও বিশ্বভারতীর দুই বিদ্যালয় পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছাত্রীরা রাখীপূর্ণিমার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তাদের সহপাঠী, কর্মি ও শিক্ষকমণ্ডলীর হাতে পরিয়ে দেওয়ার জন্য শুরু করে নিজ হাতে রঙ-বেরঙের সুতো দিয়ে রাখী তৈরি।

রাখীবন্ধন উৎসবের মধ্যে অন্তর্নিহিত মূল কথাটি হল স্নেহপ্রীতির বন্ধন— ঐক্যের বন্ধন, আর রাখী তারই প্রতীক। উৎসব প্রিয় বাঙালি রাখীপূর্ণিমার দিনটিকে এক উৎসবে পরিণত করেছে। তারা প্রতীক্ষা করে থাকে তাদের প্রিয়জনের হাতে রাখী বেঁধে দিতে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের মধ্যে এক প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখা যায়— কার শুভাকাঙ্খী বেশি, কে কতগুলি রাখী পেয়েছে, কার হাতের রাখীটা সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয়।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর