Thursday, April 10, 2025

সাঁওতাল সমাজের উপকথা ও মিথ রয়েছে ‘যাদো’-দের পট চিত্রে (ভিডিও সহ)

- Advertisement -

‘যাদো’-রা দুই ধরণের পট অঙ্কন করত, চারনি পট ও পারণি পট। চারনি পট গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে সঙ্গীত সহযোগে উপস্থাপন করত। পারণি পট ছিল পরলৌকিক সংক্রান্ত পট। এখানে তাঁরা মৃতের নিকট আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে মৃত ব্যক্তিকে বৈতরণী পার করার কাজটি সম্পন্ন করত। এক্ষেত্রে ‘যাদো’-দের এই পট পরলৌকিক সংক্রান্ত পট ও ইহলৌকিক জগৎতের পটও বলা যেতে পারে।


সাঁওতাল

মৃত্যুর পর ধর্ম ভেদে মরদেহ আগুনে পোড়ানো হয় বা মাটিতে কবর দেওয়া হয় (যদিও ব্যতিক্রমও রয়েছে)। যুগযুগ ধরে এই রীতিই চলে এসেছে এবং তা ক্রমশ চলমান। এক্ষেত্রে আগুনে পোড়ানো বা মাটিতে কবর দেওয়ার কিছুকাল পর মরদেহের অবশেষ আর প্রায় কিছুই থাকে না বললেই চলে।

যদিও একাধিক ধর্ম মতে এখানেই সব শেষ নয়। কারণ ওই দেহের ‘আত্মা’ অবিনশ্বর। মৃত্যুর পর মরদেহ পরিত্যাগ করে সেই ‘আত্মা’ খুঁজে পেতে চায় অন্য আর এক নতুন শরীর। তবে তার আগে ‘আত্মা’-র স্বর্গ বা নরক দর্শন অতি আবশ্যক।

হিন্দু সমাজে মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির ‘আত্মা’-র শান্তি ও মুক্তি কামনায় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেন সমস্ত বাঁধা ও বিপদ পেরিয়ে তিনি স্বর্গ অভিমুখে যাত্রা করতে পারেন। এক্ষেত্রে ওই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সমস্ত প্রক্রিয়াটিই ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতেরা পরিচালনা করে থাকেন। কিছু সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই ধরণের বিশেষ একটি কার্যক্রম চলে। যা পরিচালনা করেন ‘যাদো’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। যদিও এই ‘যাদো’ সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে সাঁওতাল দের জাতিগত কোনও সম্পর্ক নেই।

‘যাদো’ শব্দটি এসেছে ‘যাদু’ থেকে। যার অন্য অর্থ ‘ইন্দ্রজাল’। সাঁওতাল দের ধারণা, ‘যাদো’-রা যাদু অর্থাৎ ইন্দ্রজাল জানেন। মৃত্যুর পর মৃতদের স্বর্গ যাত্রার পথ ‘যাদো’-রাই দেখিয়ে দিতে পারেন। ‘যাদো’-দের মতানুযায়ী, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি স্বর্গের পথ দেখতে পান না। কারণ তখন তার চোখ থাকে না। মৃত ব্যক্তি স্বপ্নে তাঁদেরকে দর্শন দিয়ে থাকে। তখন ‘যাদো’-রা মন্ত্র সহ ‘পট’ অঙ্কনের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে দেন। এই ‘পট’ চিত্র ‘সাঁওতালি পট’ নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। যদিও এই ‘সাঁওতালি পট’ বর্তমানে প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছে।

- Advertisement -


‘যাদো’-রা এক সময়ে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত। তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করত আদিবাসী বিশেষ করে সাঁওতাল জনজাতির ছবি এঁকে। সাঁওতাল দের সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসের সুযোগে তাঁরা সাঁওতালি ভাষা ও রীতিনীতিও প্রায় শিখে নিয়েছিল। ‘যাদো’-রা দুই ধরণের পট অঙ্কন করত, চারনি পট ও পারণি পট। চারনি পট গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে সঙ্গীত সহযোগে উপস্থাপন করত। পারণি পট ছিল পরলৌকিক সংক্রান্ত পট। এখানে তাঁরা মৃতের নিকট আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে মৃত ব্যক্তিকে বৈতরণী পার করার কাজটি সম্পন্ন করত। এক্ষেত্রে ‘যাদো’-দের এই পট পরলৌকিক সংক্রান্ত পট ও ইহলৌকিক জগৎতের পটও বলা যেতে পারে।

বীরভূম জেলার রাজনগর ব্লকের ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী একটি প্রান্তিক আদিবাসী প্রধান গ্রাম বড়োখাটা। এখানেই বসবাস করছে কয়েকটি ‘যাদো’ পরিবার। তাঁদের কয়েকজন আজও বংশ পরম্পরার ধারা মেনে ‘সাঁওতালি পট’ অঙ্কন করে থাকেন। এই পরিবারগুলির অন্যতম সদস্য বাবুধন চিত্রকর জানালেন, তাঁদের এই কার্যক্রমের মধ্যে ‘চক্ষুদান’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। মৃত্যুর পর যেহেতু মৃত ব্যক্তির কোনও চোখ থাকে না। তাই তারা স্বর্গের পথও দেখতে পান না। ‘যাদো’-রা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী স্বপ্নে তা সবই প্রায় বুঝতে পারেন। তখন তাঁরা পট চিত্রে চক্ষু অঙ্কনের মাধ্যমে আত্মার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেন।

‘যাদো’-দের এই পট চিত্র অবশ্য অতি সহজ ও সরল। এখানে ব্যবহৃত রঙ ও তুলি তাঁরা নিজেরাই অতি সাধারণভাবে তৈরি করে থাকেন। ‘যাদো’ সম্প্রদায়ের অপর সদস্য লাল্টু চিত্রকর এবিষয়ে জানালেন, তিনি রঙের জন্য ভূষ কালি ও বাবলা গাছের আঠা ব্যবহার করে থাকেন। তুলি তৈরি করেন ছাগলের গলার কাছের লম্বা লোম ও বাঁশের কাঠি দিয়ে।

যদিও তাঁদের দিন চলে অতি কষ্টে। মৃতের বাড়ি থেকে সামান্য যা কিছু সংগ্রহে আসে, তা দিয়ে সংসার চালাতে বেশ বেগ পেতে হয় তাঁদের। তাই বিকল্প আয়ের পথ বেছে নিয়েছেন তাঁদের অনেকেই। পট অঙ্কনের প্রতিও রয়েছে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের অনীহা। লাল্টু চিত্রকর সেবিষয়ে অনেকটা আক্ষেপের সুরেই জানালেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা এখন আর কেউ ‘পট’ অঙ্কন করতে চাই না। তাই তাঁদের পরবর্তী সময়ে হয়তো এই ‘আদিবাসী পট’-ই কোনও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ‘যাদো’-দের এই ‘সাঁওতালি পট’ হয়তো বর্তমান শিক্ষিত সমাজের কাছে অলৌকিক বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই তাঁদের অনন্ত ও অকৃত্রিম বিশ্বাস। আর এরই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সাঁওতাল সমাজের মৌলিক ও লৌকিক উপকথা এবং মিথ।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর