Friday, April 11, 2025

সব পেয়েছির আসর এ ছেলেবেলার স্মৃতি আঁকড়ে রয়েছে আমোদপুর

- Advertisement -

আমোদপুরের সব পেয়েছির আসর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিল এখানকার সোনার কাঠিদের অনবদ্য কুশলতায়। সোনার কাঠিদের দ্বারা প্রদর্শিত ভারতীয় লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান জেলা ছাড়িয়ে বিভিন্ন রাজ্য দর্শক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। মেয়েদের মধ্যে শান্তা রায়, টাবলী নন্দী, কাকলী নাগ চৌধুরী, সোনালী ব্যানার্জী, অজ্ঞলী সূত্রধর, রূপালী ব্যানার্জী, পাপড়ী চ্যাটার্জী এবং ছেলেদের মধ্যে পঙ্কজ মণ্ডল, নিমাই চৌধুরী, সুদীপ্ত দাস, করুণা চ্যাটার্জী, কিশোর সেন, দিলীপ দাস, প্রশান্ত চ্যাটার্জি ভারতীয় লোকনৃত্য ও সব পেয়েছির আসর এর সাথে যুক্ত ছিলেন।


সব পেয়েছির আসর
Image by Michal Jarmoluk from Pixabay

বর্তমান দিনে দাঁড়িয়ে যথোপযুক্ত শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশের সংগঠনের দেখা পাওয়া দুষ্কর। অথচ একটা সময় ছিল, যখন কিছু সংগঠন সাংস্কৃতিক বিকাশে নতুন দিশা দেখিয়েছিল। “সব পেয়েছির আসর” হল এমনই একটি শিশু বিকাশের মুক্ত মঞ্চ।

প্রবাদপ্রতিম শিশু সাহিত্যক অখিলবন্ধু নিয়োগী বা স্বপনবুড়ো এই শিশু সংগঠনের মূল অগ্রদূত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘ছোটদের পাততাড়ি’ নামে একটি শিশুদের বিভাগ চালু হয়। ১৯৪২ সালের মে মাসে এই বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব নেন স্বপনবুড়ো। এই বিভাগ পরিচালনা করতে করতে শিশুদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দক্ষতা সম্বন্ধে ও তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন থেকেই এই বিভাগের সাংগঠনিক রূপ দিতে শুরু করেন “সব পেয়েছির আসর” এর পরিকাঠামোতে। আর ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে পাঁচজন শিশুকে নিয়ে শুরু করেন “সব পেয়েছির আসর”। শিশুদের শারীরিক, সংস্কৃতিপ্রবণ ও মানসিক বিকাশের জন্য সব পেয়েছির আসর এর পরিধি ধীরে ধীরে কলকাতা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে।

বীরভূম জেলায় সর্বপ্রথম সব পেয়েছির আসর এর শাখা গড়ে ওঠে আমোদপুর শহরে। পরে ধীরে ধীরে বীরভূমে লাভপুর, সাঁইথিয়া, বোলপুরের পাড়ুলডাঙা, মহম্মদবাজার এবং বর্ধমান জেলার বনপাসে এই সংগঠনের শাখা গড়ে উঠতে শুরু করে। বর্ধমান জেলার শাখাটি বীরভূম জেলার শাখার মধ্যেই ধরা হয়।

আশির দশকের প্রথমদিকে আমোদপুরে অনেকগুলি নাট্যদলের মধ্যে একটি ছিল “মগনেশ্বরী নাট্য সংস্থা”। এই নাট্যদল বিভিন্ন জায়গায় নাটক প্রদর্শন করত। একবার দুর্গাপুরের একটি নাটক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে “ছোটদের সাগরডাঙা” নামে একটি শিশু সংগঠনের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে। তখন এই সংস্থার কর্মীবৃন্দদের মাথায় অনুরূপ শিশু সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা আসে। মগনেশ্বরী নাট্য সংস্থার কর্মীরা দেখা করেন এই শিশু সংগঠনের অন্যতম কারিগর বৈদ্যনাথ অধিকারীর সঙ্গে। তার সাহায্যে আমোদপুরে সব পেয়েছির আসর এর রূপরেখা তৈরি হয়।

- Advertisement -

১৯৮০ সালের ২ অক্টোবর আমোদপুরে প্রথম কবি সুকান্তের নামে সব পেয়েছির আসর এর প্রতিষ্ঠা হয়। সেবার মোট ১৭৫ জন শিশুকে নিয়ে গড়ে ওঠে এই আসর। সব পেয়েছির আসর এ শিশুরা পরিচয় পেত “সোনার কাঠি” নামে। সোনার কাঠিদের বিভিন্ন ধরনের শারীরশিক্ষার কাজে যুক্ত করে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা বাড়ানো হত।

সব পেয়েছির আসর এর কর্মীদেরও বিশেষ অভিধা থাকত, আর সেটা হল “সংঘমিত্র”। আমোদপুরের সব পেয়েছির আসর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিল এখানকার সোনার কাঠিদের অনবদ্য কুশলতায়। সোনার কাঠিদের দ্বারা প্রদর্শিত ভারতীয় লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান জেলা ছাড়িয়ে বিভিন্ন রাজ্য দর্শক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। মেয়েদের মধ্যে শান্তা রায়, টাবলী নন্দী, কাকলী নাগ চৌধুরী, সোনালী ব্যানার্জী, অজ্ঞলী সূত্রধর, রূপালী ব্যানার্জী, পাপড়ী চ্যাটার্জী এবং ছেলেদের মধ্যে পঙ্কজ মণ্ডল, নিমাই চৌধুরী, সুদীপ্ত দাস, করুণা চ্যাটার্জী, কিশোর সেন, দিলীপ দাস, প্রশান্ত চ্যাটার্জি ভারতীয় লোকনৃত্য ও সব পেয়েছির আসর এর সাথে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের “রাখাল ছেলে” “আচ্ছাজব্দ” নাটকের প্রদর্শন করে এখনকার সোনার কাঠিরা।

মূলত চারটি পদ্ধতিতে সোনার কাঠিদের মূল্যায়ন করা হত, যথা প্রবেশিকা, মধ্যম, অগ্রণী ও অগ্রদূত। বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয়ক যেমন ব্রতচারী, লাঠিখেলা, নানা ধরনের ড্রিল এর মধ্য দিয়ে শিশুদের শারীরিক গঠনকে তৈরি করা হত। এখানকার শিশুদের নিয়ে বছরে দু-বার জুন ও ডিসেম্বর মাসে ক্যাম্পের আয়োজন করা হত।

১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম সর্বভারতীয় পর্যায়ে ক্যাম্পের আয়োজন করার দায়িত্ব পায় আমোদপুরের সব পেয়েছির আসর। তবে প্রথম বছর আমোদপুরে ক্যাম্পের আয়োজনের জন্য যথেষ্ট অর্থ ছিল না। খুবই চিন্তায় ছিলেন আয়োজকেরা। সর্বভারতীয় ক্যাম্পের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সময়ও ছিল না উদ্যোক্তাদের। এক মাসেরও কম সময় ছিল হাতে। সেই সময় আমোদপুর শহরের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী প্রেমসুখ সারদা ও মহাদেব দত্ত বিপুল পরিমাণে অর্থ সাহায্য করেন ক্যাম্পটির আয়োজন সফল করতে। ৭ দিন ধরে চলা সেই ক্যাম্পে এসেছিলেন বিভিন্ন স্থানের গুণী ব্যক্তিরা।

এরপর আমোদপুরের সব পেয়েছির আসর সর্বভারতীয় ক্যাম্পের আয়োজন করেছিল যথাক্রমে ১৯৯৩ ও ২০০৩ সালে। শেষ ২০১৬ সালে সর্বভারতীয় ক্যাম্পের আয়োজন করেছিল  আমোদপুরের এই সংগঠন। এই সব ক্যাম্পগুলিতে ভারত ছাড়াও নেপাল, বাংলাদেশ থেকেও সব পেয়েছির আসর এর প্রতিনিধিরা আসতেন।

কেন্দ্রীয় শিবির কমিটির সচিব প্রসূন চ্যাটার্জী জানালেন, “একটা সময় বীরভূম জেলার আমোদপুর অঞ্চলের সব পেয়েছির আসর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিল। শিশু ও মায়েদের মুখে মুখে এই সংগঠনের প্রশংসা ঘুরে বেড়াত। সর্বোচ্চ ২৭৫ জন সোনার কাঠি উপস্থিত হয়েছিল এখানে। এখানে শিশুরা আসার জন্য এতটাই উদগ্রীব হয়ে থাকত যে একটা সময় মাইকে করে ঘোষণা করা হত কত সর্বোচ্চ পরিমাণ শিশু এই সংগঠনের মধ্যে আসতে পারবে।”

বর্তমানে বিনোদন মাধ্যমের দাপট, ঘরে ঘরে অন্তজাল শিশুদের মানসিক বিকাশ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। সব পেয়েছির আসর যে লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। বর্তমানে আমোদপুরের সব পেয়েছির আসর এ ২০-২৫ জন সোনার কাঠি রয়েছে। তবুও অনেক মানুষের ছেলেবেলার স্মৃতিতে বেঁচে রয়েছে এই আসরের ইতিহাস। বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির সচিব তথা সব পেয়েছির আসর এর প্রাক্তন জেলা সংগঠক প্রশান্ত চ্যাটার্জি এখন আমোদপুরের কবি সুকান্ত সব পেয়েছির আসর এর ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর