Friday, April 18, 2025

সতীর একান্ন পীঠ এর অন্যতম কঙ্কালীতলার সাধক ছিল ‘জগদীশবাবা’

- Advertisement -

সতীর একান্ন পীঠ এর অন্যতম পীঠ কঙ্কালীতলার সাধক ছিলেন জগদীশ মজুমদার। তিনি কঙ্কালীতলাতেই সিদ্ধিলাভ করেন। পরে তাঁর নাম হয় ‘জগদীশ বাবা’ বা ‘কঙ্কালীবাবা’। শোনা যায়, প্রভূত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। সাধক বামাখ্যাপা যখন দেহ ত্যাগ করেন ‘জগদীশ বাবা’-র বয়স ছিল তখন মাত্র সতেরো।


সতীর একান্ন পীঠ

হিন্দুদের একান্নটি সতীপীঠ এর অন্যতম বীরভূম জেলার কঙ্কালীতলায় যে ক’জন সাধক সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জগদীশ মজুমদার। কঙ্কালীতলায় কঠোর সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে ‘জগদীশ বাবা’ বা ‘কঙ্কালীবাবা’ নামে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। স্বর্গীয় বিশ্বম্ভর মজুমদার (মাখন) ও স্বর্গীয়া বিন্ধ্যবাসিনী মজুমদার ছিলেন তাঁর পিতা ও মাতা। তারাপীঠের মন্দির (চণ্ডীপুর মৌজা) থেকে দুই মাইল দক্ষিণে তারাপুর গ্রামে (তারাপুর মৌজা) তাঁর জন্ম ২৯ ভাদ্র ১৩০১ সালে (১৮৯৪ খ্রীঃ)। তাঁদের আদি পদবী ছিল ‘নারায়ণ’, পরে কোনও এক সময় হয় ‘মুখোপাধ্যায়’ (ভরদ্বাজ গোত্র) এবং এখন নবাবী পদবী ‘মজুমদার’। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে, তাঁর ভাইপো তারাপুর গ্রামের ৬২ বছর বয়সী জয়দেব মজুমদার পদবীর পরিবর্তন প্রসঙ্গে জানান, তিন পুরুষ আগে চাঁদপাড়া থেকে (পদবী ছিল মুখোপাধ্যায়) কেউ তারাপুর গ্রামে মামার বাড়িতে (মজুমদার) থাকতে আসেন। গ্রামের লোকেদের মুখে কালক্রমে তিনি হয়ে যান ‘মজুমদার বাড়ির ছেলে’। তখন তাঁরা গ্রামের একমাত্র পুরোহিত হওয়ায় অনেকে ‘ঠাকুরমশাই’ বা ‘ঠাকুর বাড়ির ছেলে’ বলেও সম্ভাষণ করতেন।

তারাপুরে একটি লেংড়িগোড়ে (ছোট ডোবা) ছিল, যেখানে গ্রামের লোকেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ ধরে এনে জমা করতেন। পরবর্তীকালে ভূমিক্ষয় ও গ্রামে কিছু মাটির বাড়ি তৈরিতে মাটি সংগ্রহের ফলে ডোবাটি আকারে বড় হতে থাকে। বর্তমানে ডোবাটিকে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। জগদীশ মজুমদার মাত্র এগারো মাস বয়সে ডোবাটিতে পড়ে গিয়ে ডুবে প্রাণ হারান। তাঁর পিতা-মাতার বিনীত অনুরোধে তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপা ও আট জন মহাপুরুষের (এঁদের মধ্যে ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, নিগমানন্দ, জগৎগুরু শঙ্করাচার্য প্রভৃতি) আট দিন ব্যাপী একটি বন্ধ ঘরে একটানা ধ্যানে তিনি পুনরুজ্জীবন লাভ করেন। ধ্যানে বসার আগে বামাক্ষ্যাপা বিশ্বম্ভর বাবুকে বলেছিলেন, ওই শিশুকে সৎকার না করতে, ওই শিশু একজন সাধারণ বালক নয় এবং সে কখনও সংসারে মনোনিবেশ করবে না, আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি তাঁর টান থাকবে (প্রশান্ত মজুমদার- অঞ্জলি, পৃ. ২)। জগদীশ মজুমদারের সতেরো বছর বয়সে বামাক্ষ্যাপা দেহত্যাগ করেন। জয়দেব মজুমদারের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় তিনি জগদীশবাবাকে বামাক্ষ্যাপার দেওয়া একটি কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি দেখান, যেটি এখনও জয়দেব মজুমদারের বাড়িতে নিয়মিত পূজিত হয়।

ছোটবেলা থেকেই জগদীশ মজুমদার খুব ডাকাবুকো প্রকৃতির ছিলেন। পাড়ার পাঠশালায় ভর্তি করা হলেও পড়াশোনায় মন ছিল না। পাঠশালা থেকে পালিয়ে বামাক্ষ্যাপার কাছে চলে যেতেন। পরিবারের পক্ষ থেকে তিনি যাতে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ না করেন সেজন্য মাত্র পনেরো বছর বয়সে রামপুরহাটের হাসান গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ কুলদারঞ্জন চক্রবর্তীর মাত্র সাত বছরের কন্যা কালীদাসীর সাথে বিবাহ দিয়ে সংসারমুখী করার চেষ্টা করা হয়, যদিও সেই চেষ্টা বিফল হয়। কালীদাসী পরবর্তীকালে ‘বড় মা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁদের এই বিবাহে কোনওরূপ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। উভয়ে রামকৃষ্ণ ও সারদাদেবীর মতো জীবনযাপন করতেন। তাঁরা উভয়েই তারাপীঠের সাধিকা রাঙামার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে সাধন-ভজন শুরু করেন। বৈবাহিক জীবনে অশান্তি দেখা দিলে রাঙামা জগদীশ মজুমদারকে বেশ কিছুদিন তাঁর আশ্রমে রাখেন ও পরবর্তীকালে হিমালয়ে চলে যেতে পরামর্শ দেন। প্রায় ত্রিশ বছর হিমালয় ও অন্যান্য স্থানে সাধনা করে ১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ তিনি কঙ্কালীতলায় আসেন (বুদ্ধদেব আচার্য- বেদগর্ভা কঙ্কালী, পৃ. ৩২)। কঙ্কালীপীঠে আরণ্যক পরিবেশে সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন ও ‘জগদীশবাবা’ বা ‘কঙ্কালীবাবা’ নামে খ্যাতি অর্জন করেন। জগদীশবাবার অনুরোধে বোলপুরের তৎকালীন বিডিও তারকচন্দ্র ধর কঙ্কালীতলার মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। তাঁর সিদ্ধিলাভের স্থানটি এখানে ইঁটের বেদী করে ঘিরে রাখা আছে। তিনি যে কুঁড়েঘরটিতে থাকতেন সেটি এখন আর নেই, তাঁর স্মৃতিতে কঙ্কালীতলা মন্দিরে প্রবেশের মুখে ডান দিকে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

কালক্রমে জগদীশবাবার সাধনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তাঁর শিষ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সাঁইথিয়ার ভোলানাথ দত্ত (প্রয়াত জননেতা ও সমাজসেবক নীহার দত্তের পিতা) ও গোপাল মোড়ল তাঁর দুই প্রিয় বাল্যবন্ধু ছিলেন। জগদীশবাবা কোথাও গেলে ভোলাবাবুর গরুর গাড়ি করেই যেতেন। জগদীশবাবার অন্যতম শিষ্য ছিলেন দুমকার বিখ্যাত ব্যবহারজীবি কালিদাস গুপ্তের ভাইপো তারাদাস গুপ্তের পুত্র ধ্রুবজ্যোতি গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী মণিকা গুপ্ত। এখনও দুমকাতে ধ্রুবজ্যোতি গুপ্তের কন্যা সোমা গুপ্তের (ঝুমু) মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবার জগদীশবাবার আশ্রম পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার কার্ত্তিক নস্কর, গোবিন্দচন্দ্র নস্কর, সিউড়ির সুনীতি চট্টরাজ, সিউড়ির ব্যবহারজীবি ঘনশ্যাম পতিতুণ্ডি ও চিকিৎসক কালীগতি ভট্টাচার্য, বোলপুরের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক শৈলেন দাস (কল্পনা হোমিও হল), বীরভূম জেলার মিল মালিক সিউড়িনিবাসী সতীশচন্দ্র ঘোষ, সেচ বিভাগের চিফ্‌ ইঞ্জিনিয়ার মহেশ্বর প্রসাদ বর্মন ও তাঁর স্ত্রী সত্যবতী বর্মন, বীরভূম জেলার চিফ্‌ এগ্রিকালচার অফিসার কৃষ্ণশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দী সিনেমা আর্টিস্ট প্রদীপ কুমার, গায়ক শ্যামল মিত্র, শান্তিনিকেতনের শিল্পী মুকুল দে সহ আরও অনেকে।

- Advertisement -

অল্প সময়ের মধ্যে কলকাতাতেও জগদীশবাবার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার অনুরাগীরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে নরেন্দ্রপুরের কাছে কুমড়োখালিতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে বিহারের দুমকা জেলার ধাদকিয়াতেও অনুরূপ আর একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য কলকাতানিবাসী ভক্তরা সেখানকার তৎকালীন প্রশাসকের সহায়তায় জগদীশবাবাকে প্রায় ১৫-১৬ বিঘা জমি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ধাদকিয়ার আশ্রমে পরবর্তীকালে দায়িত্বপ্রাপ্তা হন তাঁরই শিষ্যা হুগলীর উত্তরপাড়ার সতীদেবী, শিষ্যদের কাছে তিনি ‘সতীমা’ নামে অধিক পরিচিতা ছিলেন। বিবাহিতা জীবনে সন্ন্যাস নিয়ে স্বামী ও এক কন্যাকে ছেড়ে সতীমা জগদীশবাবার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। প্রিয় শিষ্যার নামে জগদীশবাবা এই আশ্রমের নাম দেন ‘সতন আশ্রম’।

জগদীশবাবার অনেক অলৌকিক কাহিনী এখনও লোকমুখে প্রচলিত আছে। যেমন- জয়দেব মজুমদার তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে শোনালেন, অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন একদিন জগদীশবাবা ও সিউড়ির চিকিৎসক কালিগতি ভট্টাচার্যের সাথে পুরন্দরপুরের (বোলপুর-সিউড়ি বাসরুটে ডানদিকের রাস্তায় ২০০ মিটার দূরত্বে, বর্তমানে পাকা রাস্তা) কাছে ‘বেহিরা নিম্ববাসিনী কালীমাতা’ মন্দিরে যান। জগদীশবাবা মেঝেতে আলতা পরা পায়ের ছাপ দেখিয়ে বলেন মাকালী এখান দিয়ে হেঁটে গেছেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পায়ের ছাপগুলি বিলীন হয়ে যায়। আবার, বোলপুরের প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক শৈলেন দাসের কথানুসারে, বীরভুম জেলার তৎকালীন জজসাহেব রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কঙ্কালীতলায় জগদীশবাবাকে প্রত্যক্ষ করতে এসে দেখেন সাপ পরিবেষ্টিত হয়ে একজন সাধুবাবা ধ্যানমগ্ন আর তাঁর চারদিকে প্রচুর গাঁজার গাছ। জজসাহেব তৎক্ষণাৎ পেয়াদা পাঠিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পুরে দেন। বিচারের দিন জগদীশবাবাকে বিচারকক্ষে আনলে জজসাহেব দেখেন পেয়াদা, কর্মচারি, জুরী সকলকেই জগদীশবাবার মতো দেখতে লাগছে। জজসাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে জগদীশবাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চান ও পরবর্তীকালে তিনিও জগদীশবাবার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

জীবনের শেষ পর্যায় জগদীশবাবা তারাপুরে অতিবাহিত করার পর ১৭ মাঘ ১৩৮২ বঙ্গাব্দে, শনিবার একাশি বছর বয়সে কলকাতায় দেহ রাখেন। বর্তমানে তারাপুরে তাঁর সমাধিস্থলে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর সহধর্মিণী কালীদাসী দেব্যা ২৬ আষাঢ় ১৩৯২ (১১ জুলাই ১৯৮৫) দেহ রাখলে তাঁকেও এই আশ্রম কেন্দ্রেই সমাধিস্থ করা হয়। এখানে নিত্যপুজো, জগদীশবাবার জন্মদিন (২৯ ভাদ্র) ও মৃত্যুদিন (১৭ মাঘ) এবং গুরুপূর্ণিমা উপলক্ষে মহা-উৎসব হয়ে থাকে। অবিনাশপুরে জগদীশবাবার শিষ্য শ্রীকুমার মুখার্জীর বাসের কণ্ডাক্টার আমোদপুরের নোয়াপাড়াবাসী ৭৭ বছর বয়সী মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম থেকে অদ্যাবধি প্রায় সাতচল্লিশ বছর আশ্রমের সেবাইত নিযুক্ত আছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জগদীশবাবা ছিলেন প্রচারবিমুখ, তাঁর দেহত্যাগের পরে তাঁর সহধর্মিণী কালীদাসী কয়েকজনকে শিষ্যত্ব দিলেও তাঁর অবর্তমানে আর কাউকে শিষ্যত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে যাননি এবং তাঁর দেওয়া শিষ্যদের মধ্যেও জীবিত শিষ্যের সংখ্যা বর্তমানে সাত কি আট। আবার, পৌরহিত্যেও জয়দেব মজুমদারই ‘বংশের শেষ প্রদীপ’, তাঁর একমাত্র পুত্র দিব্যজ্যোতি (নারায়ণ) তাঁর বাপ-ঠাকুরদার মতো পুজো-আর্চাতে বিশ্বাসী নন আর জগদীশবাবার মেজভাই যোগেশচন্দ্র আঠার বছর বয়সে মারা যান, সেজ ভাই শরৎচন্দ্র ছিলেন নিঃসন্তান। এমতাবস্থায় কঙ্কালীতলার অন্যতম সাধক জগদীশবাবার সমাধিস্থল তারাপুর আশ্রমে ভবিষ্যতে উৎসবাদি কিভাবে পালিত হবে বা আশ্রম পরিচালনার বিপুল ব্যয়ভার কে বহন করবে তা নিয়ে স্বয়ং সেবাইত মোহিতবাবু, জগদীশবাবার ভ্রাতুষ্পুত্র জয়দেব মজুমদার ও তারাপুরবাসীর কণ্ঠেও বিষাদ ও অনিশ্চয়তার সুর প্রতিধ্বনিত হয়।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর