Friday, April 18, 2025

রাখড়েশ্বর শিব মন্দির : প্রচারের আলো থেকে দূরেই রয়েছে এখনও (ভিডিও সহ)

- Advertisement -

রাখড়েশ্বর শিব মন্দির এর নামকরণের কারণ সন্ধানে জানতে পারা গেল, উনবিংশ শতকের দিকে একবার ঝাড়খণ্ডের মলুটি গ্রামের জমিদার রাখড়নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কাঞ্চিদেশ (বর্তমানে নাম কংকালীতলা)-এর জমিদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের পূর্বে এই শৈবপীঠে এসে মানত করেন যে, যুদ্ধে জয়লাভ করলে এখানে আরও একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। পরে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন তিনি। ধারণা করা হয়, তাঁর নামানুসারেই এই মন্দিরের নাম রাখা হয়েছে রাখড়েশ্বর শিব মন্দির।


শিব মন্দির

সমগ্র বীরভূম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য দেব-দেবীর মন্দির। সতীর ৫১ পীঠের ৫টা পীঠ যেমন এখানে রয়েছে, ঠিক তেমনি তারাপীঠের মতো বেশ কয়েকটি সিদ্ধপীঠও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটিতে। এর কোনও কোনওটির বয়স আবার কয়েকশো থেকে হাজার বছরও ছাড়িয়ে গিয়েছে। এখানে সমস্ত পীঠই কিন্তু ঐতিহাসিক দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই পীঠস্থানগুলির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বীরভূমের প্রকৃত ইতিহাস।

বীরভূমের এই রকমই একটি প্রাচীন পীঠস্থানের নাম রাখড়েশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরটি এই জেলার লাভপুর শহরের দক্ষিণ দিকে চৌহট্টা-মহোদরী পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ছে। রাখড়েশ্বর শিব মন্দির টি এই পঞ্চায়েতের যে গ্রামে অবস্থান করছে সেটির নাম এই মন্দিরের নামানুসারেই রাখা হয়েছে, রাখড়েশ্বর। গ্রামটির পাশ দিয়ে মৃদু-মন্দ গতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে গিয়েছে কোপাই নদী।

প্রতিটা পীঠেরই একটা ইতিহাস থাকে। রাখড়েশ্বর শিব মন্দির এরও রয়েছে। ইতিহাসের সন্ধানে গিয়ে জানতে পারা গেল, অতীতে এই রাখড়েশ্বর গ্রামটি ছিল বারানসীপুর মৌজার অন্তর্গত। গ্রামটির পশ্চিম দিকে ছিল একটি ঘন জঙ্গল। সেখানে বিনা কারণে কোনও সাধারণ মানুষের যাতায়াত ছিল না। তবে গোচারণার জন্য কয়েকজন রাখালের পছন্দের জায়গা ছিল এটি।

একবার গোচারণ করতে গিয়ে একজন রাখালের নজরে পড়ল, তার পালের গরুর একটি জঙ্গলের মধ্যবর্তী একটি অংশে আপনমনে একটি পাথরের উপর দুধ ঢালছে। কাছে গেলে রাখালটির নজরে পড়ল সেটি কোনও সাধারণ পাথর নয়, একটি শিবলিঙ্গ। পরে গ্রামবাসীদের ঘটনাটি জানালে, তারা শিবলিঙ্গটি সেখান থেকে তুলে এনে রাখড়েশ্বর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করে।

- Advertisement -

পরে বোলপুরের নিকটবর্তী সুপুর-রায়পুর গ্রামের জমিদার জগমোহন সিংহ সন্তান লাভের আশায় এই শৈবতীর্থে এসে মানত করেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। পরে তিনি সন্তানলাভ করলে ১৭৩৪ শকাব্দ বা ১৮১২ খৃস্টাব্দ নাগাদ এখানে একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন। যে শিব মন্দিরটিতে আজও নিত্য পুজো হয়ে চলেছে।


প্রাচীন রাখড়েশ্বর শিব মন্দির

মূল মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমে আর একটি অনুচ্চ টেরাকোটা অলঙ্কৃত শিব মন্দির রয়েছে। টেরাকোটার অলংকরণে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। এই মন্দিরের গায়েই রয়েছে একটি পোড়ামাটির শিলালিপি। ঐতিহাসিকদের ধারণা এখানে লিখিত লিপি বাংলা প্রাকৃত ভাষায় লেখা। যদিও তার কিছুই আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মূল মন্দিরের দক্ষিণ পশ্চিমে আরও একটি দেউল প্রকৃতির শিব মন্দির রয়েছে। যদিও এর গায়ে কোনও টেরাকোটার অলঙ্করণ নেই।

রাখড়েশ্বর শিব মন্দির সম্পর্কে রয়েছে একাধিক জনশ্রুতি। তার মধ্যে একটি মন্দিরের দ্বার প্রসঙ্গে। সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনও মন্দিরের দ্বার পশ্চিম দিকে রাখা হয় না। কিন্তু রাখড়েশ্বর শিব মন্দির এর দুটি প্রবেশ দ্বারের একটি রয়েছে উত্তর দিকে, অপরটি পশ্চিমে। জনশ্রুতি বলছে, একবার এক অন্ধ ভক্ত মন্দির চত্বরের পশ্চিম দিকে বসে অসাধারণ সুরে গান গাইছিল। তার গানে মুগ্ধ হয়ে স্বয়ং মহাদেব তাকে সম্মুখে এসে গান গাইতে বলে। ভক্ত তখন মন্দিরে প্রবেশের কোনও দ্বার খুঁজে পায় না। মহাদেব তখন নিজেই পশ্চিম দিকে ঘুরে যায়। তারপরই পশ্চিম দিকে আর একটি দ্বার নির্মাণ করা হয়েছে।

রাখড়েশ্বর শিব মন্দির এর নামকরণের কারণ সন্ধানে জানতে পারা গেল, উনবিংশ শতকের দিকে একবার ঝাড়খণ্ডের মলুটি গ্রামের জমিদার রাখড়নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কাঞ্চিদেশ (বর্তমানে নাম কংকালীতলা)-এর জমিদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের পূর্বে এই শৈবপীঠে এসে মানত করেন যে, যুদ্ধে জয়লাভ করলে এখানে আরও একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। পরে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন তিনি। ধারণা করা হয়, তাঁর নামানুসারেই এই মন্দিরের নাম রাখা হয়েছে রাখড়েশ্বর শিব মন্দির। বর্তমানে এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বিশ্বনাথ ভারতী (বন্দ্যোপাধ্যায়) ওরফে মাকরভারতী তাঁরই বংশধর।

অন্যসব শৈবপীঠের তুলনায় এই রাখড়েশ্বর শিব মন্দির প্রচারের আলো থেকে বেশ অনেকটাই দূরে রয়েছে। তবে বহুকাল ধরে এখানে নিত্য পুজো হয়ে চলেছে। এখানে অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও ভক্তরা পুজো দিতে আসে। নিত্য পুজো চললেও চৈত্র সংক্রান্তি ও শিবরাত্রিতে এখানে বিশেষ পুজোর দেওয়া হয়। গাজনে এখানে বেশ বড়ো-সড়ো একটি মেলাও বসে।

তবে আধুনিকতার রূপ দিতে গিয়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মন্দির গাত্রের প্রাচীন ঐতিহ্য, মুছে যাচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস। মন্দিরের অলঙ্কৃত টেরাকোটার শিল্পকর্মেও আধুনিকতার টান দিতে গিয়ে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে এর আদিরূপ।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর