ভারতীয় সংস্কৃতিতে রথযাত্রা য় এক জাতি, এক প্রাণ, একতা রবীন্দ্রনাথের কল্পলোকের বাস্তব ‘ভারততীর্থ’-এর রূপ নেয়। আধ্যাত্মিক অর্থে জগন্নাথ হলেন ব্রহ্ম বা স্থিতিশক্তি, সুভদ্রা ব্রহ্মের নীলাময়ী শক্তি বা ক্রিয়াশক্তি, বলরাম হলেন জীবজগৎ- এই তিনের সমন্বয়ে সৃষ্ট হয় রথ। শরীরের সঙ্গে রথের তুলনা করে বলা যায়, ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়াগুলি শরীর রথটিকে সংসারপথে টেনে নিয়ে যায়।

‘রথযাত্রা লোকারণ্য, মহা ধূমধাম / ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম / পথ ভাবে আমি দেব / রথ ভাবে আমি / মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী’। “কালের যাত্রা” নাটকে এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রথযাত্রা কে মানব সভ্যতার জয়যাত্রা রূপে কল্পনা করেছেন। তাঁর মতে সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র জনসাধারণ, রশি জনগণের ঐক্যবন্ধন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’, মোক্ষলাভের বাসনা। রবীন্দ্রনাথ তাই আহ্বান করেছেন, ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে / ওই-যে তিনি, ওই-যে বাহির পথে।। / আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি- / ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি!’
মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বা অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীতেও রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে রথ হল ভগবানের যাতায়াতের জন্য কাষ্ঠনির্মিত যান। তাঁদের কাছে ‘যাত্রা’ শব্দের অর্থ গমন, যার বিশেষ অর্থ উৎসব। যেমন- দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি। সূর্যের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম হল রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে হয় সোজারথ এবং একাদশী তিথিতে হয় ফিরতি রথ বা উল্টো রথ। শাস্ত্রমতে, জগন্নাথদেব জ্যৈষ্ঠের স্নানযাত্রা থেকে রথযাত্রা র আগে অবধি ১৫ দিন মহালক্ষ্মীর সাথে নিভৃতে বাস করে তাঁর অনুমতি নিয়ে নীলাচল থেকে সুন্দরাচলে (বৃন্দাবন) গমন করে শ্রীরাধার সাথে মিলিত হন। প্রবাদ আছে, শ্রীবিষ্ণু রামেশ্বরে স্নান করেন, বদ্রিনাথে ধ্যানে বসেন, পুরীতে আহার করেন ও দ্বারকায় বিশ্রাম নেন। এই ‘চারধাম’-এর মধ্যে পুরী রথযাত্রার জন্য বিখ্যাত। ওড়িশার পুরী শহরের রথযাত্রা প্রাচীনতা ও ঐতিহ্যের দিক থেকে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, হুগলির শ্রীরামপুরের মাহেশ ও নবদ্বীপের ইস্কনের রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ। অন্যান্য দেবতাদেরও রথযাত্রা আছে। যেমন- দক্ষিণ ভারতে নটরাজের বা বীরভূমের তারাপীঠে মা তারার রথ।
পৌরাণিক উপাখ্যানে জগন্নাথ দেবের উদ্ভবের কাহিনী থেকে জানা যায়, দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর একদিন দ্বারকায় একটি গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে বিশ্রাম করছিলেন। জরা নামে এক ব্যাধ দূর থেকে লাল দুটি পা দেখে ভুলবশত টিয়া পাখি ভেবে শরবিদ্ধ করেন। কৃষ্ণ পার্থিব দেহত্যাগ করে বিষ্ণুলোকে যাত্রা করেন। সমুদ্রতীরে মৃতদেহ দাহ করার সময় গোটা শরীর পুড়লেও নাভিদেশ পোড়েনি। অর্জুনের নির্দেশে দাহকারীরা ‘পরমব্রহ্ম’ সেই আধপোড়া দেহ সমেত কাঠের গুড়ি সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। অল্প দূরেই কলিঙ্গ রাজ্যে (তখন নাম ছিল মালবদেশ) শবররাজ বিশ্ববসু সেই ভাসমান কাঠ সংগ্রহ করেন ও নিভৃতে বনান্তারালে ওই দেহাংশকে ‘নীলমাধব’ দেবতাজ্ঞানে নিত্যপুজো শুরু করেন। জরা ব্যাধ ছিলেন আসলে শবর-রাজা বিশ্ববসু। পরবর্তীকালে পাঞ্জাব-রাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন কৌশলে সেই কাষ্ঠাংশ বিশ্ববসুর কাছ থেকে অপহরণ করেন ও তাঁর অনুরোধে দেব-কারিগর বিশ্বকর্মা মূর্তি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ধৈর্যচ্যুত হয়ে নির্মাণশালায় প্রবেশ করেন। মূর্তি নির্মাণে এই অনাকাঙ্খিত বাধা সৃষ্টি হওয়ায় মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ব্রহ্মার আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অর্ধনির্মিত মূর্তিগুলিতে প্রাণের সঞ্চার করে আরাধনার ব্যবস্থা করেন। এই মূর্তিগুলোই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। পরবর্তীকালে ইন্দ্রদ্যুম্নই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রা র সূচনা করেন।
শোনা যায়, পুরীতে রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ রথে চড়িয়ে সেবাইতরা, এমনকি রাজা প্রতাপরুদ্র সপারিষদ রশি ধরে সর্বশক্তি দিয়ে টানলেও রথের চাকা একটুও নড়েনি। এমতাবস্থায় চৈতন্যের নিদানে নিম্নবর্গের অচ্ছুত অন্ত্যজ শবরদের সংস্পর্শে রথের চাকা ঘুরতে শুরু করে। আজও তাই প্রথা মেনে রথযাত্রা উপলক্ষে পুরীতে স্নানযাত্রার দিন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে অভিষেকের পর অস্পৃশ্য এই আদিম অধিবাসীদের সহায়তায় তিনটি সুসজ্জিত রথে তোলা হয়। সর্বাগ্রে ‘তালবীজ’ বা ‘তালধ্বজ’ নামে রথে থাকেন বলরাম। এই রথের রঙ লাল ও নীল, চাকার সংখ্যা ১৪টি। মাঝখানে ‘দেবদলন’ রথে থাকেন সুভদ্রা। এই রথের রঙ লাল ও কমলা, চাকা ১২টি। সবশেষে থাকেন জগন্নাথ ‘নন্দীঘোষ’ রথে। এই রথের রঙ লাল ও হলুদ, চাকার সংখ্যা ১৬টি, উচ্চতা ৪৫ ফুট। রথযাত্রা উপলক্ষে নানা বিধি এখনও অনুসরণ করা হয়, যাতে জগন্নাথের উপর কোনও অপদৃষ্টি না পড়ে। মন্দির থেকে বিগ্রহ বের করার সময় তাঁর হাতে নানা গাছের লতাপাতা, শিকড় বেঁধে দেওয়া হয়। রথের সারথি উচ্চস্বরে অশ্লীল গালাগালি দেন সম্ভাব্য অপদৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যে, অনেকটা আমাদের বিয়েবাড়িতে ছাদনাতলায় পরামাণিক যেমন গালিমিশ্রিত ছড়া কাটেন।
পুরী ছাড়া অন্যত্র অবশ্য রথযাত্রা য় তিনটি পৃথক রথ থাকে না। ঢালাই লোহা বা কাষ্ঠনির্মিত চার চাকা বিশিষ্ট মন্দিরসদৃশ একটি রথ বলরাম, জগন্নাথ ও সুভদ্রার বিগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন রাস্তায় প্রদক্ষিণ করে। সামনে থাকে হরিনাম সংকীর্তনের দল। রথে থাকা ফল, ফুল, বাতাসা বা নকুলদানা কিছু দূর অন্তর পুরোহিত দর্শানার্থীদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা নারী, পুরুষ, বাচ্চা সকলে সেই ‘মহাপ্রভুর প্রসাদ’ গ্রহণে তৎপর হয়ে পড়েন। শাস্ত্র মতে ‘রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম বিদ্যতে’, অর্থাৎ রথে অবস্থিত জগন্নাথের শ্রীবিগ্রহ দর্শনে জন্মান্তর গ্রহণের দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রথযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত রথের মেলায় পাঁপড়ভাজা, জিলিপি ইত্যাদি খাওয়া আর রথের রশি টানার উন্মাদনা চোখে পড়ে।
লৌকিক বিশ্বাসে রথযাত্রা য় মানুষ ও দেবতার এক সুন্দর ও সহজ যোগ স্থাপিত হয়। রথের পথই দেবতার ধূলামন্দির। এই সময় পুজোর ভার থাকে অব্রাহ্মণদের হাতে। যবন, শবর, ম্লেচ্ছ সবাই এখানে আসন পান। ভারতীয় সংস্কৃতিতে রথযাত্রা য় এক জাতি, এক প্রাণ, একতা রবীন্দ্রনাথের কল্পলোকের বাস্তব ‘ভারততীর্থ’-এর রূপ নেয়। আধ্যাত্মিক অর্থে জগন্নাথ হলেন ব্রহ্ম বা স্থিতিশক্তি, সুভদ্রা ব্রহ্মের নীলাময়ী শক্তি বা ক্রিয়াশক্তি, বলরাম হলেন জীবজগৎ- এই তিনের সমন্বয়ে সৃষ্ট হয় রথ। শরীরের সঙ্গে রথের তুলনা করে বলা যায়, ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়াগুলি শরীর রথটিকে সংসারপথে টেনে নিয়ে যায়। রথরূঢ় দেবতা হলেন নির্লিপ্ত আত্মা। দেহরূপ রথের দেবতা এই আত্মাকে জানা-ই হল রথযাত্রা, সংসারযাত্রার মূল উদ্দেশ্য। এই আত্মাকে সব রূপে জানা-ই হল পুনর্জন্ম, ‘ন বিদ্যতে’। রথের চারটি চাকা হল ‘চতুঃবর্গ’- ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। আর ভিন্ন দৃষ্টিতে ‘আত্মানাং রথীনং বিদ্ধি শরীর রথমেবতু’, অর্থাৎ আত্মাকে ‘রথী’ বলে জানা, বুদ্ধিকে ‘সারথি’ বলে জানা, মনকে ‘লাগাম’ বলে জানা। যে ব্যক্তি মনকে সংযত রেখে অন্তর পবিত্র রেখে বুদ্ধি বিবেকের দ্বারা দেহ রথকে চালনা করেন তিনি মুক্তি লাভ করেন। বাঙালি রথযাত্রা বা উল্টোরথের দিনকে পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করে শুভকার্যে ব্রতী হন, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর সূচনা এই দিনেই হয়।
জগন্নাথ অর্থাৎ ‘জগতের নাথ’ বা ‘জগতের প্রভু’ আসলে সবার ঈশ্বর। মন্দির পরিচালন পরিষদের নিয়মের বেড়াজালে যে সকল সম্প্রদায় সারা বছর মন্দিরে প্রবেশের সুযোগ পান না, তিনি জাতধর্ম নির্বিশেষে সকলকে দর্শন দিতে বছরে অন্তত একটি বার মন্দিরের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে প্রকট হন সকলের মাঝে। কিন্তু এই বছর বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ (কোভিড ১৯) আবহে লকডাউনের জেরে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অধিকাংশ রথযাত্রা। সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে অধিক জনসমাগম এড়াতে তেমনভাবে কোনও চিরাচরিত বড়ো রথকেই পথে বেরোতে দেখা যায়নি। তাই দেখা যায়নি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উল্লেখিত সেই পরিচিত ছবিটা, ‘বসেছে আজ রথের তলায় / স্নানযাত্রার মেলা- / …আজকে দিনের মেলামেশা / যতই খুশি ততই নেশা…’।