Wednesday, March 12, 2025

রজুকান, অন্ধকারাচ্ছন্ন যে শহরটিকে আলোকিত করে সুবিশাল ৩টি আয়না

- Advertisement -

রজুকান, নরওয়ের সেই রহস্যময় শহর। উনিশ শতকের প্রথম পর্যন্ত এখানে কোনও জনবসতি ছিল না। ছিল পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট একটি উপত্যকা। তার ঠিক পাশেই পাহাড়ি জলপ্রপাত। পরে ধীরে ধীরে এখানে একটি জনপদ গড়ে ওঠে। আরও পরে ব্যবসায়ী শ্যাম আইদ এখানে একটি সার তৈরির কারখানা স্থাপন করেন।

রজুকান
Rjukan – Image by -Mausi- from Pixabay

প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে শীত প্রধান নরওয়ে-তে বছরে ছয় মাস খুব ভালভাবে সূর্যের আলো পাওয়া যায়। তখন এখানে অবস্থান করে গ্রীষ্মকাল। বছরের কয়েকটা দিন দিনের অংশ এখানে এতটাই বড় হয়, যে মাঝরাতেও সূর্যের দেখা পাওয়া যায়। সূর্য যেন ডুবতেই চায় না। আর তাই নরওয়ে বিশ্বের কাছে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ নামে বেশি পরিচিত।

তারপর ধীরে ধীরে সূর্যের আলো কমতে শুরু করে। শীতের মরশুমে দিন যেন শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়। এই সময়ের কয়েকটা দিন সূর্যের দেখা একেবারেই মেলে না। আর যে দিনগুলিতে সূর্যের দেখা মেলে তাও সাময়িক কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক মিনিটের জন্য। তখন নরওয়েবাসীর হা-হুতাশের শেষ থাকে না। শীতের দিনে সূর্যের একটু আলো বা উষ্ণতা না পেলে কি চলে?

এই নরওয়ে-তেই এমন একটি শহর রয়েছে, যে বাকি দেশ থেকে সে যেন সম্পূর্ণ পৃথক। কারণ শীতের মরশুমে সমগ্র নরওয়ে যেটুকু সূর্যের আলো পায়, এই শহর তার ছিটেফোঁটাও পায় না। কারণ শহরটির চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। যার মাথা ডিঙিয়ে কোনওভাবেই শীতের সূর্য এখানে প্রবেশ করতে পারে না। সমগ্র শীতকাল গোটা শহর যেন অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকে। সে থাকুক। কিন্তু শহরবাসীর তো আর ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। তাহলে বেঁচে থাকার তাগিদতাই হারিয়ে যাবে।

কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে এখানেও টিকে রয়েছে বেঁচে থাকার সমস্ত রসদ। খুব ভালভাবেই টিকে রয়েছে শহরের প্রাণ। কারণ শীতের মরশুমেও আলোকিত হয় এই শহর। কৃত্রিম উপায়ে নয়, আলোর প্রতিফলনে। শীতের যেটুকু আলো নরওয়ের জন্য বরাদ্দ, তার কিছুটা সুবিশাল তিনটি আয়না পাহাড়ের চূড়া থেকে এখানে প্রতিফলিত করে। তাতেই জেগে থাকে রজুকান।

- Advertisement -

রজুকান, নরওয়ের সেই রহস্যময় শহর। উনিশ শতকের প্রথম পর্যন্ত এখানে কোনও জনবসতি ছিল না। ছিল পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট একটি উপত্যকা। তার ঠিক পাশেই পাহাড়ি জলপ্রপাত। পরে ধীরে ধীরে এখানে একটি জনপদ গড়ে ওঠে। আরও পরে ব্যবসায়ী শ্যাম আইদ এখানে একটি সার তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এখান থেকেই বহির্বিশ্বে পাঠাতেন সেই সার। ধীরে ধীরে রজুকান –এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের কাছে। পরে ১৯৯৬ সাল নাগাদ রজুকান –কে শহরের মর্যাদা দেয় নরওয়ে সরকার।

তবে শ্যাম আইদ জানতেন, রজুকান শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা শীতের অন্ধকার পরিবেশ। বহু চেষ্টা করেও সেই অন্ধকার সরাতে পারেননি তিনি। জলপ্রপাতকে কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করেছেন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিয়েছেন সমগ্র রজুকান অঞ্চলে। কিন্তু স্থায়ী সমাধান আদৌ হয়নি।

পরে সেই সমস্যার সমাধান করেন মার্টিন অ্যান্ডার্সন। তিনি দেখেছেন, শীতের মরশুমে একটু রোদের ছোঁয়া পেতে রজুকান শহরের অধিকাংশ মানুষ পাহাড় চূড়ায় উঠতেও পিছপা হয় না। তাতে জীবনের ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সময়ের অপচয়। যদি কোনওভাবে সূর্যের আলোকেই শহরে আনা যেত, এতটা কষ্ট করতে হত না শহরবাসীদের। কিন্তু কীভাবে?

আলোক রশ্মি আয়নায় প্রতিফলিত হয়। আলোক বিজ্ঞানের এই ধর্মকেই কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লাগলেন তিনি। শুরু করলেন তার কাজ। পঞ্চাশ ফুট উচ্চতার তিনটি সুবিশাল আয়নাকে স্থাপন করলেন পাহাড় চূড়ায়। আয়না তিনটিকে বয়ে নিয়ে যেতে তাঁকে অবশ্য ভাড়া করতে হয়েছিল হেলিকপ্টার।

কিন্তু একটি দিকে স্থাপন করা থাকলে সূর্যের আলো সবসময় পাওয়া যাবে না। কারণ পৃথিবী ঘুরছে। সেই সঙ্গে সূর্যের অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটছে। এর জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি দশ সেকেন্ড অন্তর আয়না ঘোরানোর ব্যবস্থা করেন। যাতে সূর্যের উপস্থিতিতে সব সময়ই তার দিকে মুখ করা থাকবে। আর সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র রজুকান শহরে।

এখন রজুকান শহর শীতেও আলোকিত হয়। এমনকি শীতের মরশুমে যারা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেন, তারাও উল্লাসে নিজেদের কর্মব্যস্ত রাখেন। একবারও ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে না। মার্টিন-এর এই ব্যবস্থার কথা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে, এখন পর্যটকদেরও ভিড় বাড়ে রজুকান শহরে। সমগ্র শহরের চেহারাটাই বদলে গেছে কয়েক বছরের মধ্যে।

মার্টিন অ্যান্ডার্সন-এর এই আয়না ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়েছিল ২০১৩ সালে নাগাদ। আর এই ব্যবস্থায় মোট খরচ পড়েছিল প্রায় ছয় কোটি টাকা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রথম দিকে মার্টিন অ্যান্ডার্সন-কে এই কাজে প্রায় কেউই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। হয়তো অধিকাংশেরই ধারণা ছিল, মার্টিন-এর এই ব্যবস্থা কোনওভাবেই সফল হবে না। কিন্তু তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে সফল হয়ে দেখিয়েছেন।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর