চাহিদা-যোগানের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে মানুষের অন্ধবিশ্বাস, সম্প্রতি মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা ছড়াচ্ছে, ‘লেবু ও সরিষার তেলে করোনা দূর হয়’। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বেশি বেশি পরিমাণে ভোজ্য তেল ব্যবহার করছে। আর মানুষের এই অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে রমরমিয়ে চলছে তেলের কালোবাজারি। সাথে পেট্রোল, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ।

সম্প্রতি ভারতে ভোজ্য তেল (সরিষা, বাদাম, পাম, শোয়াবিন, বনস্পতি, সূর্যমুখী, অলিভ, রাইস ব্যান)-এর দাম ৪০-৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ হিমশিম খাচ্ছে বর্ধিত দামে তেল কিনে হেঁসেলে যোগান দিতে। মানুষের মুখে মুখে, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এর চর্চাও এখন বিস্তর। কিন্তু হঠাৎ করেই ভোজ্য তেল এর দাম গত বছরের তুলনায় কেন এতটা বৃদ্ধি পেল?
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতীয়রা অন্যান্য দেশের তুলনায় তেল একটু বেশি পরিমাণেই ব্যবহার করে থাকে, তা সে বাঙালির মাছের ঝোলেই হোক বা পাঞ্জাবীদের ‘মশালাদার পরাঠা’ কিংবা হায়দ্রাবাদের ‘বিরিয়ানী বা শাহী মোগলাই’-এ। ভারতীয়দের খাদ্যাভাসের এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
পরিসংখ্যানে আরও বলছে, ভারতীয়রা বছরে ২৩-২৫ মিলিয়ন টন ভোজ্য তেল ব্যবহার করে থাকে, যার অর্ধেকের বেশি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ এদেশে দেশীয় জোগান মাত্র ৮-১০ মিলিয়ন টন। স্বভাবতই উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা এখানে অনেকটাই বেশি। আর এটাই দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
চাহিদা-যোগানের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে মানুষের অন্ধবিশ্বাস, সম্প্রতি মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা ছড়াচ্ছে, ‘লেবু ও সরিষার তেলে করোনা দূর হয়’। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বেশি বেশি পরিমাণে ভোজ্য তেল ব্যবহার করছে। আর মানুষের এই অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে রমরমিয়ে চলছে তেলের কালোবাজারি। সাথে পেট্রোল, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ।
ভারতবর্ষ যেহেতু বিশ্ববাজারের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেল এর বিষয়ে অস্থিরতার (দাম বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বর্ধিত কর, শ্রমিক সমস্যা, পরিবহণ সমস্যা) সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ভারতীয় বাজারে।
এছাড়া আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে বর্তমানে Bio-Diesel প্রস্তুত করার জন্য সোয়াবিন তেলের ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপক হারে, যা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা সহ বিভিন্ন দেশে যাত্রীবাহী যানবাহন চালানো হচ্ছে। সে কারণে হঠাৎ করে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ভারত সরকার ‘আত্মনির্ভর ভারত’ কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের নামের আড়ালে চীনা কোম্পানিগুলি বিনা শুল্কে রমরমিয়ে ভারতে ভোজ্য তেলের সরবরাহ করছিল। সরকার এই বিষয়টি আটকানোর জন্য ও দেশীয় উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য বিদেশ থেকে আসা ‘Final Product’-এর উপর আমদানি শুল্ক ৪০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে, তাতে চিনা কোম্পানিগুলিকে আটকানো সম্ভব হয় এবং একই সাথে ভারতে কাঁচামালের আমদানি ও বিদেশী লগ্নি বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া (এখান থেকে ভারতবর্ষ সর্বাধিক পাম তেল আমদানি করে), ইউক্রেন সহ বিভিন্ন দেশ কাঁচামালের উপর রপ্তানি শুল্ক বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে ভারতবর্ষকে বেশি দামে কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে।
তবে এই মূল্য বৃদ্ধিতে লাগাম টানতে ভারতের দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে বিদেশী নির্ভরশীলতা কম করতে হবে, আর তার জন্য প্রয়োজন আরও উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনা, সেচের সুবিধা, প্রযুক্তি ও উদ্যোগের উন্নতিসাধন। এছাড়া সরকার যদি আমদানি শুল্কসহ বিভিন্ন কৃষি উন্নয়ন উপকর (Cess) কম করে, তাহলে এই বর্ধিত দামে লাগাম টানা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ।