রাঢ় বাংলার প্রধান লোকউৎসবের মধ্যে ‘ভাদু উৎসব’ অন্যতম। শরৎ ঋতুর ভাদ্র মাসে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। একাধিক সূত্র অনুযায়ী, আনুমানিক প্রায় ২০০ বছর আগে এই লোকসংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভদ্রাবতী নামে এক রাজকন্যার স্মৃতি। আসলে ভদ্রাবতী-ই এখানে ‘ভাদু’। প্রথম দিকে ভাদুর কোনও বিমূর্ত রূপ ছিল না। পরে ভাদু র মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

‘ভাদু উৎসব’ পশ্চিমবঙ্গের আনুমানিক ২০০ বছরের প্রাচীন একটি লোকসংস্কৃতি। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ‘ভাদু উৎসব’ এখনও বীরভূমের গ্রামে গ্রামে জিইয়ে রয়েছে। মাটির ভাষায়, মেঠো শব্দ উচ্চারণে গাওয়া গান ভাদু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। অঞ্চল ভেদে লোকসংস্কৃতির উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যই লোকসংস্কৃতির আকর্ষণীয় বস্তু হিসাবে দেখা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলায় যে ভাদু উৎসব উদযাপিত হয় তার থেকে বীরভূম বা বর্ধমানের এই লোকায়ত লোকউৎসব ও লোকসঙ্গীত তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে অনেকটাই আলাদা। ভাদ্র মাস কৃষিপ্রধান গ্রাম বাংলায় এক অবসরের মাস। সারা অলস ভাদ্র মাস জুড়ে অন্ত্যজ শ্রেণীর পুরুষ ও মহিলাদের সাথে কুমারী মেয়েরাও ভাদু উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
কে এই ভাদু
ভাদু উৎসব নিয়ে বহু লোককাহিনী প্রচলিত আছে। অনুমান করা হয়, ভাদু উৎসবের আড়ালে অন্তর্নিহিত আছে এক রাজকুমারীর করুণ কাহিনী। পুরুলিয়ার কাশিপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংদেওয়ের তৃতীয় কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী, রাজবাড়িতে সকলে আদর করে ডাকতেন ‘ভাদু’। ভদ্রাবতীর বিবাহ স্থির হয় বীরভূমের এক রাজপুত্রের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের দিন সেই বর রাজবাড়িতে আসার সময় ডাকাতদের আক্রমণে অকালে মারা যান। শোকে উদ্ভ্রান্ত ভদ্রাবতী নদীর জলে ডুবে (মতান্তরে চিতার আগুনে) আত্মহত্যা করেন। কন্যার এই আত্মবলিদানের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন। সেই থেকে নীলমণির কন্যা সকলের কন্যা রূপে আজও বেঁচে আছেন রাঢ় বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
ভাদু উৎসব সূচনার পশ্চাতে লোকমুখে তৈরি হওয়া এই কাহিনী নানা রঙ, পাঠ্যন্তরে অন্য আর এক কাহিনীর জন্ম দেয়। এই কাহিনী অনুসারে, ভদ্রাবতী বীরভূমের হেতমপুরের রাজকন্যা। বিবাহের দিন ইলামবাজারের চৌপারির শালবনে ডাকাতদের আক্রমণে তাঁর হবুবর বর্ধমানের রাজপুত্রের মৃত্যু হলে সহমরণে যান। সম্ভবত, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে (১২২০ বঙ্গাব্দ) ভদ্রাবতীর স্মৃতিরক্ষার্থেই ভাদুউৎসবের সূত্রপাত।
ভাদু উৎসবের স্বরূপ
ভাদু হলেন কৃষিলক্ষ্মী। ভাদ্র মাসের সূচনার দিন গ্রামবাসীরা গ্রামের একজন ছোট মেয়েকে অথবা কোনও ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার কোলে একটি মাটির তৈরি ভাদু মূর্তি বসিয়ে দেন ও গ্রামের পুরুষদের দল নাচ সহযোগে ভাদু গান পরিবেশন করেন। নিজ গ্রামে বা পার্শ্ববর্তী শহরে এসে বাড়ি বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে গান শুনিয়ে কিছু অর্থ সংগ্রহও করেন। পাঁচালি পাঠের মতো সুর করে ও মাঝে মাঝে সমবেত কণ্ঠে গানের একটি পংক্তি পুনরাবৃত্তি করে ভাদুগান পরিবেশিত হয় ও বাচ্চা মেয়েটি বা মেয়ের সাজে সজ্জিত ছেলেটি গানের সাথে সাথে নৃত্য প্রদর্শন করেন।
প্রথাগত বিশ্বাসানুসারে, ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে ভাদু জাগ্রত হন। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে একটি নির্দিষ্ট স্থানকে সজ্জিত করে ভাদুমূর্তি স্থাপন করেন ও পরের দিন সকালে প্রধান গায়েনকে অনুসরণ করে পুরুষদের দল হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, ঢোল, কাঁসি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ভাদুগান গাইতে গাইতে নিকটবর্তী কোনও জলাশয়ে মূর্তি বিসর্জন দেন।
ভাদু এখানে গৃহকন্যা
বীরভূম জেলার কোটা-শীর্ষা, সুরুল, যাত্রা, ইলামবাজার, কোপাই, আমোদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ভাদু উৎসবের ব্যাপক অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অনেকের মতে, আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে বর্ষাকালে করম গান ও উৎসব পালন করার যে রীতি আছে ভাদুগান ও ভাদু উৎসব তারই হিন্দু সংস্করণ। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণির রুচি সম্মত ভাদুগানে ভাষা বা ভাবের পরিপাটি না থাকলেও গ্রাম্যভাবের পরিবেশনে স্বাভাবিকভাবেই বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
ভাদু গানই উৎসবের প্রধান অঙ্গ। আর যেহেতু ভাদু একজন গৃহকন্যা, কোনও দেবী নন, তাই এই উৎসবে কোনও পুরোহিত লাগে না অথবা সংস্কৃতের সন্ধি, সমাসযুক্ত কঠিন কোনও শব্দবিন্যাসে কোনও মন্ত্রপাঠ করা হয় না। কোনও অধিবাস বা আমন্ত্রণের প্রয়োজন হয় না বা কোনও তিথি-নক্ষত্র মেনে চলার বালাই নেই। হারমোনিয়াম, ঢোল, পাখোয়াজ, কাঁসি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে মার্গধর্মীয় উচ্চ-সাহিত্য গুণ নির্ভর ভাদুগান কালক্রমে লোকসঙ্গীত হিসেবে জনমানসে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাদ্র মাসে ভদ্রাবতীর জন্ম ও মৃত্যু বলে অনেকে ভাদ্র মাসকে মলমাস বলে মনে করেন। এই মাসে কোনও শুভ কাজে ব্রতী হন না। আশ্চর্যের বিষয়, উচ্চাঙ্গ মার্গসঙ্গীতের এই ঘরানা একটি লোকসঙ্গীত, অথচ এর প্রতিষ্ঠা হয় পঞ্চকোটের রাজপরিবারের সদস্য ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও ও রাজনারায়ণ সিংদেও প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতায়।
ভাদু মূর্তি
প্রথম দিকে ভাদু র কোনও বিমূর্ত রূপ না থাকলেও বর্তমানে মূর্তির প্রচলন দেখা যায়। এই উৎসবের সূচনাকালে একটি পাত্রে ফুল বা গোবর রেখে তার উপরে কিছুটা ধান ছড়িয়ে ভাদু র রূপ কল্পনা করে আরাধনা ও উৎসব উদ্যাপিত হত। এখন যে মূর্তিগুলি দেখা যায় সেখানে ভাদু হাঁস, ময়ূর অথবা পদ্মফুলের উপর উপবিষ্ঠা একজন দেবী, তাঁর গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, গলায় পদ্মের মালা, হাতে পদ্মফুল ও হাতের তলায় আলপনা আঁকা থাকে। অনেকাংশে মূর্তির কোলে একটি রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি বা কৃষ্ণমূর্তি থাকে। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির সাতদিন পূর্বে ভাদু মূর্তি ঘরে আনা হয়। সংক্রান্তির আগের দিন ভাদুর জাগরণ পালিত হয়।
ভাদু গান
সাধারণ গৃহনারীদের জীবন কাহিনী ভাদুগানের মূল উপজীব্য। কুমারী ভদ্রাবতীর স্মৃতি রোমন্থনে বিবাহপ্রধান গান ভাদু উৎসবের মূল আকর্ষণ হলেও বর্তমানে প্রেম ও রাজনীতি, দৈনন্দিন সমাজ জীবনের নানা অসঙ্গতির ছবি বা সমাজ সচেতনামূলক বিষয়বস্তু সহজ ও সরলভাবে সরস ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তোলা হয়। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদুগানগুলিতে রামায়ণ, মহাভারত বা কৃষ্ণ-রাধার প্রেম পাঁচালী আকারেও গাইতে শোনা যায়।
বীরভূমের ইলামবাজার এলাকা থেকে সংগৃহীত ‘ভাদু আমার ছুটু ছেলে / কাপড় পড়তে জানে না, / ভাদু ফড়ক ছেড়ে কাপড় পড়েছে / তাই কাপড়ের গিট লাগে না…’, বাহিরী অঞ্চলে প্রচলিত ভাদুগান ‘ভাদুমণি, ভাদু তুমি / কোথায় যাবে বলো না, / একটা কথা শোন না, / ভাদু ছিলে বারো মাসে / ভাদু এলে ভাদ্র মাসে…’, অথবা সম্প্রতি কোটা-শীর্ষা এলাকা থেকে সংগৃহীত ‘ভাদু আমার গরবিনী / ওহে আমার ভাদুমণি / মাথায় দিব সোনার মুকুট / শাড়ি দিব জামদানি…’, বা সুরুল থেকে সংগৃহীত ‘ভাদু রূপেতে আলা, গলেতে মালা / জড়ি বসানো ভাদুর গামছাতে’ ইত্যাদি ভাদুগানগুলিতে মেঠো শব্দ প্রয়োগে পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থা বা সাধারণ গৃহনারীদের জীবন কাহিনী উত্থাপনে আঞ্চলিকতার স্বাদ বিশেষ আকৃষ্ট করে। বীরভূমের বাহিরি অঞ্চল থেকে সম্প্রতি সংগৃহিত এক ভাদুগানে পণপ্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে শোনা যায়, ‘বড়লুকের কাঙাল পুতে / পণের লেগে দুহাত পেতে / জান থাকতে দুবনা ভাদু / সেই ছেলের হাতে…’।
ভাদু উৎসব ও বর্তমান সমাজ
লোকসংস্কৃতির ধনাগার গ্রাম-বাংলায় ঝুমুর, কবি, বোলান, ঘেঁটু, পট, কীর্তন, ভাঁজো, বাউল প্রভৃতি বিচিত্র নামের ও ঢঙের লোকসঙ্গীতের সাথে সাথে ভাদুগানও এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তবে সময় বদলেছে। মানুষের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে। মানব জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি কৃত্রিম যান্ত্রিকতার যুগে ভাদু উৎসব বা ভাদু গান প্রায় বিলুপ্ত হতেই বসেছে। শহুরে শিক্ষিত ভাদু গান রচয়িতারাও ভাদু গান রচনার কাজে হাত লাগানোর ফলে অথবা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সম্প্রচার, সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত ভাদু গানে আধুনিক শব্দগুচ্ছ ব্যবহারে ভাদু গানে মেঠো ভাষার অবলুপ্তি লক্ষ্য করা যায়। লুপ্তপ্রায় লোকায়ত ভাদুগানের নিজস্বতাকে টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি দপ্তর বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আঞ্চলিক স্তরে ভাদু গানের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।