Friday, April 18, 2025

বই বাঁধাই : যান্ত্রিক সহজলভ্যতায় কদর কমেছে শিল্পী ‘জ্ঞানদা’-র

- Advertisement -

কেমনভাবে বাঁধাই করতে হয় বই? জ্ঞানদা জানালেন, হাতে বই বাঁধাই কিছুটা সময় সাপেক্ষ। এব্যাপারে প্রথমে বইয়ের পাতাগুলি ‘জুতো সেলাই’ করে নিতে হয়। বই যদি অত্যধিক জীর্ণ হয়ে থাকে, তখন ‘ল্যাপ্টা সেলাই’ দিয়ে পরে ‘পেটাই সেলাই’ দিতে হয়। মলাট দেওয়ার আগে ভালো করে আঠা লাগানো হয়। এক্ষেত্রে তিনি নিজেই বাড়িতে আঠা তৈরি করে নেন। এরপর রয়েছে পিচবোর্ডের কাজ। অনেক সময় বইয়ের পাতা সমান করতে সেলাইয়ের আগে হাতুড়ির সাহায্য নিতে হয়।


বই বাঁধাই
Image by Michal Jarmoluk from Pixabay

বইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বই বাঁধাই শিল্প। কেননা বইকে সযত্নে রাখা বা দুষ্প্রাপ্য বইকে সংরক্ষণ করতে বই বাঁধাই-এর কোনও বিকল্প নেই। এই শিল্প বহু প্রাচীন। তবে যন্ত্র সভ্যতার এই আধুনিক সময়ে বই বাঁধাই-এর মতো সুপ্রাচীন শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। সেই সঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও তাঁদের পেশাও। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে এই পেশা আজ আক্ষরিক অর্থে অনেকটাই ব্যতিক্রমধর্মী।

বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া ব্লকের আমোদপুরে আজও নিজের হাতে বই বাঁধিয়ে চলেছেন ৭২ বছরের প্রবীণ জ্ঞানেন্দ্রনাথ মন্ডল। স্থানীয়দের কাছে যিনি ‘জ্ঞানদা’ নামে পরিচিত। আমোদপুরের স্কুলবাগানে তাঁর বাড়ির দোতলায় পৌঁছে গেলে দেখা যাবে, স্থূল বিবর্ণ, জরাজীর্ণ, মলিন বইগুলিকে কতটা যত্ন নিয়ে সেলাই করছেন তিনি নিপুণভাবে। এই সময়ে আমোদপুর অঞ্চলের তিনিই একমাত্র বই বাঁধাই শিল্পী।

বাবা জগন্নাথ মন্ডল ছিলেন কৃষক। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়ো। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই তিনি যুক্ত হন প্রেসের কাজে। ১৯৬৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমোদপুরের চন্ডীকা প্রেসে যুক্ত হন তিনি। সেসময় আমোদপুরে এটিই ছিল একমাত্র প্রেস। আর এখান থেকেই বই বাঁধাই শিল্পে হাতে খড়ি তাঁর। তখন মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৫০ টাকা। তবে এখানে দুবছর কাজ করার পর অধিক রোজগারের তাগিদে তাঁকে যেতে হয় সাঁইথিয়া, বোলপুর, বরাকর সহ আরও বিভিন্ন প্রেসে। এর মধ্যে বোলপুরের শ্রীলক্ষ্মী প্রেসেই কেটে গিয়েছে তাঁর কর্মজীবনের ২৮টি বছর।

২০০০ সাল থেকে একের পর এক প্রেসে প্রবেশ করতে শুরু করল কম্পিউটার। যারা কম্পোজিটারের কাজ করতেন তাদের কদর কমতে শুরু করল ধীরে ধীরে। একইভাবে প্রেসের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরাও কাজ হারাতে থাকলেন ধাপে ধাপে। এইভাবে বই বাঁধাই শিল্পেও মন্দা দেখা দিতে থাকল। জ্ঞানদা ২০০৪ সালে শ্রীলক্ষ্ণী প্রেস থেকে কাজ হারালেন। তাই ওই বছর থেকেই স্কুল বাগানের নিজের বাড়িতে বই বাঁধাই-এর কাজ শুরু করলেন।

- Advertisement -

প্রথমদিকে বইয়ের পাতার হিসাব ও আকার হিসাব করে বই প্রতি গড়ে ২৫ টাকা পেতেন জ্ঞানদা। পরে তা পৌঁছে যায় ৭০-৮০ টাকায়। শুরুর দিকে বই বাঁধাই-এর অর্ডার নিতে সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতে হত তাঁকে। এর মধ্যে আমোদপুর, হাতিয়া, চৌহাট্টা, সিউর ইত্যাদি গ্রামগুলির লাইব্রেরির পুরনো বই বাঁধাই করেছেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, স্কুল ও রেশন দোকানের খাতাও বাঁধাই করতে হয়েছে তাঁকে।

কেমনভাবে বাঁধাই করতে হয় বই? জ্ঞানদা জানালেন, হাতে বই বাঁধাই কিছুটা সময় সাপেক্ষ। এব্যাপারে প্রথমে বইয়ের পাতাগুলি ‘জুতো সেলাই’ করে নিতে হয়। বই যদি অত্যধিক জীর্ণ হয়ে থাকে, তখন ‘ল্যাপ্টা সেলাই’ দিয়ে পরে ‘পেটাই সেলাই’ দিতে হয়। মলাট দেওয়ার আগে ভালো করে আঠা লাগানো হয়। এক্ষেত্রে তিনি নিজেই বাড়িতে আঠা তৈরি করে নেন। এরপর রয়েছে পিচবোর্ডের কাজ। অনেক সময় বইয়ের পাতা সমান করতে সেলাইয়ের আগে হাতুড়ির সাহায্য নিতে হয়।

এখন আধুনিক সময়ে এসবের বালাই অবশ্য নেই। এক্ষেত্রে মেশিনের সহায়তা নেওয়া হয় প্রেসগুলিতে। সময় ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় হয় প্রেসের। তাই জ্ঞানদার মতো এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা কাজ হারাচ্ছেন ধীরে ধীরে। তবে একথা স্বীকার করেন বিশেষজ্ঞরা, যান্ত্রিক উপায়ে বই বাঁধাই শিল্প হাতে বই বাঁধাই শিল্পের তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে। কারণ তাঁদের মতে, হাতে বাঁধানো বই হয় অনেক বেশি টেকসই। যান্ত্রিক উপায়ে বাঁধানো বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বয়স বেড়েছে জ্ঞানদার। শরীরেও বাসা বেঁধেছে বয়সজনিত বিভিন্ন ব্যাধি। এখন আর আগের মতো তিনি গ্রামে গ্রামে পৌঁছে পুরনো বই সংগ্রহ করতে পারেন না। বর্তমানে আমোদপুর ও সিউর লাইব্রেরির বই বাঁধাই করেন তিনি।

এর পাশাপাশি অনলাইনের আগ্রাসনে আগের তুলনায় বই পড়ার আগ্রহও কমেছে মানুষের মধ্যে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ মন্ডল জানালেন, ‘আগে কত রাময়ণ মহাভারত-এর মতো মোটা মোটা বই বাঁধাই করতাম। এখন এই রকম বই বাঁধাই-এর অর্ডার খুব কমই আসে। এই প্রজন্ম হাতে বই বাঁধানোর কাজে নিযুক্ত হতে চায় না। তাই ভয় হয়, এই শিল্প অদূর ভবিষ্যতেই হারিয়ে যাবে হয়তো! কিন্তু আমি এই পেশাতে ভালোবেসে যুক্ত হয়েছি। তাই যতদিন বেঁচে আছি এই কাজটিকেই ভালোবেসে করে যাব।’

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর