অনেক আলোচনার পর স্কুলের কর্মকর্তারা স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এই সময়ে তাঁরা পাশে পেয়ে গেলেন ‘আমোদপুর টাউন ক্লাব’-কে। ক্লাবের সদস্য আর স্কুলের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন বোর্ডের থেকে অনুদান হিসাবে পাওয়া ২২০০ টাকা দিয়ে একটি যাত্রাপালার আয়োজন করা হবে। কলকাতা থেকে আনা হবে সেই যাত্রাদল। দর্শকের থেকে টিকিট ধার্য করে যে অর্থ উঠবে, তা দিয়েই তৈরি হবে স্কুলের বিল্ডিং।

শিশুদের বুনিয়াদ গঠনে পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ও যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। ভারতীয় সংবিধান শিশুদের শিক্ষাকে মৌলিক অধিকারের আওতায় এনেছে। সর্বশিক্ষা অভিযানের মাধ্যমে এখন প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর সঙ্গে বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও রমরমিয়ে চলছে।
তবে স্বাধীনোত্তর ভারতে শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করা ছিল অনেক বড়ো একটি সমস্যা। সমস্ত শিশুর মধ্যে শিক্ষার আলো তখন সমানভাবে পৌঁছে দেওয়াও ছিল কঠিন একটি লড়াই। কোনও একটি অঞ্চলের একটি মাত্র শিক্ষাক্ষেত্রের উপরই নির্ভর করতে হত পাশ্ববর্তী আরও অনেকগুলি অঞ্চলকে। তাই পারিবারিক শিক্ষার পরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে সদ্য শিক্ষার্থীদের মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে যেতে হত দূর-দূরান্তে। আর অনেকটা সেই কারণেই স্বাক্ষর হওয়ার সমান সুযোগ সবার থাকত না তখন।
স্বাধীনোত্তর ভারতে বীরভূম জেলার আমোদপুরে ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামটির সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও বিদ্যালয়টির স্থায়ী কোনও জায়গা ছিল না। সে সময়ে ওই স্কুলটির নাম ছিল ‘আমোদপুর বয়েজ প্রাইমারি বিদ্যালয়’। আর এটিই ছিল এই অঞ্চলের একমাত্র প্রাথমিক স্কুল। স্কুলের নামের সঙ্গে ‘বয়েজ’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এখানে মেয়েদেরও শিক্ষা দেওয়ার হত।
স্কুলটির স্থায়ী জায়গার অভাবে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমোদপুরের বিভিন্ন জায়গায় খোলা আকাশের নীচে ক্লাস নিতেন। প্রথম দিকে ক্লাস হত হাটতলার আটচালার মধ্যে। কিন্তু রবিবার ও বুধবার হাট বসার ফলে প্রতি বুধবার ক্লাস নেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন একদিনের জন্য স্কুল চলে যেত জয়দুর্গা সিনেমা হল (যদিও সেসময়ে সিনেমা হলের কোনও অস্তিত্ব ছিল না)-এর কাছে। এখানেও খোলা আকাশের নীচে গাছে বোর্ড ঝুলিয়ে চলত শিক্ষার আদান-প্রদান। এখানেও কোনও অসুবিধা দেখা দিলে স্কুল চলে যেত আমোদপুর জয়দুর্গা হাইস্কুলের মধ্যে। তাই বলা যেতেই পারে, সেসময়ে এই প্রাথমিক স্কুলটি ছিল অনেকটা ভ্রাম্যমান স্কুলের মতো।
এমনি করে বারংবার স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চলছিল ‘আমোদপুর বয়েজ প্রাইমারি বিদ্যালয়’-এর শিক্ষা প্রবাহ। স্কুলের জন্য অতি আবশ্যক ছিল একটি স্থায়ী জায়গার। যদিও কর্মকর্তারা স্কুলের একটা নিজস্ব জায়গা পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে সেই সুযোগও একদিন চলে আসে। স্কুল তখন চলে এসেছে চৌরঙ্গী পাড়ায়। সেসময় ননীগোপাল দত্ত নামের একজন স্থানীয় সহৃদয় ব্যক্তি নিজস্ব কিছু জমি দান করেন স্কুল স্থাপনের জন্য। এই জমিটি ছিল আমোদপুর-বোলপুর সড়কের তালবোনা পুকুর সংলগ্ন স্থানে।
জায়গা পাওয়া গেল। তবে স্কুল স্থাপন হবে কি করে! সেসময়ে এই অঞ্চলের একমাত্র স্কুল হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল প্রচুর। তাই বৃহৎ আকারের একটি শ্রেণীকক্ষের প্রয়োজন ছিল। অথচ অর্থের কোনও যোগান ছিল না। স্কুল বোর্ডের কাছে আবেদন জানিয়ে মঞ্জুর হল মাত্র ২২০০ টাকা। এই সামান্য অর্থ দিয়ে কোনওভাবেই স্কুলের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব নয়।
অনেক আলোচনার পর স্কুলের কর্মকর্তারা স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এই সময়ে তাঁরা পাশে পেয়ে গেলেন ‘আমোদপুর টাউন ক্লাব’-কে। ক্লাবের সদস্য আর স্কুলের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন বোর্ডের থেকে অনুদান হিসাবে পাওয়া ২২০০ টাকা দিয়ে একটি যাত্রাপালার আয়োজন করা হবে। কলকাতা থেকে আনা হবে সেই যাত্রাদল। দর্শকের থেকে টিকিট ধার্য করে যে অর্থ উঠবে, তা দিয়েই তৈরি হবে স্কুলের বিল্ডিং।
বলা বাহুল্য, হাটতলার বিশাল প্রাঙ্গণে সেই যাত্রাপালার আয়োজনে যে অর্থ সংগ্রহ হয়েছিল, তা দিয়েই তৈরি হয়েছিল আমোদপুরের প্রথম প্রাথমিক স্কুল, ‘আমোদপুর বয়েজ প্রাইমারি বিদ্যালয়’। সেসময়ে স্কুল তৈরির ব্যয় কমানোর জন্য একাধিক ব্যবস্থাও নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এমনকি ইটের খরচ বাঁচানোর জন্য স্কুল প্রাঙ্গণেই একটি ছোটো ইটের ভাটা তৈরি করেছিল টাউন ক্লাব ও স্থানীয় যুবকেরা।
এখন ১৬ আগস্ট ‘আমোদপুর বয়েজ প্রাইমারি বিদ্যালয়’-এর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়। এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন যামিনীমোহন চট্রপাধ্যায়। পরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়। মদনগোপাল বাবুর জনপ্রিয়তার জন্য একটা সময়ে এই স্কুলটি পরিচিত ছিল ‘মদন মাস্টারের স্কুল’ নামে।
স্বাধীনতার স্কুল বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অরুণ চৌধুরী একবার স্কুলগুলিকে স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর তখন থেকেই ‘আমোদপুর বয়েজ স্কুল’-এর নাম বদলে হয় ‘আমোদপুর রজতভূষণ দত্ত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। আমোদপুর নিবাসী রজতভূষণ দত্ত বীরভূম জেলা স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অবিস্মরণীয় নাম। বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিনি আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন।