এই পৃথিবীতে যত বিস্ময়কর পতঙ্গ আছে, জোনাকি তাদের অন্যতম। তাদের শরীর থেকে নির্গত হওয়া আলো তাদের এত বিস্ময়কর বানিয়েছে। তারা তাদের আলো সাধারণত একে অপরকে আকৃষ্ট করার সংকেত হিসাবে ব্যবহার করে। আলোর সংকেতের মাধ্যমে স্ত্রী জোনাকি মিলনের জন্যে তার পুরুষ সঙ্গীকে খুঁজে নেয়। দেখা গিয়েছে, পুরুষ জোনাকি র আলোর ঔজ্জ্বল্য তুলনামূলক বেশি, স্ত্রী জোনাকি তাদের প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট হয়।

রাতের অন্ধকারে প্রকৃতিকে নিজের আলোয় সাজিয়ে তুলতে জোনাকি র কোনও তুলনা হয় না। তাদের শীতল আলোয় পুরোপুরি অস্পষ্টতা দূর না হলেও প্রকৃতির নিশানগুলি ঠিকই বুঝতে পারা যায়। আসলে তারা বন-জঙ্গল বা ঝোপ-ঝাড় একটু বেশিই পছন্দ করে থাকে। লম্বা লম্বা ঘাসও ওদের খুব প্রিয়। এছাড়াও পুকুর বা হ্রদের ধারগুলিতে ওরা ঘুরে বেড়াতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। নির্জনতা একটু বেশিই ভালোবাসে বলে লোকালয়ের বাইরে ফাঁকা মাঠের ওপর উড়তে ওদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
প্রজাতি বিভাগ
এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০০০ ধরণের জোনাকি র সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। বৈশিষ্ট্যগতভাবে এদের আবার কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন, ফোটিনিনি (এই শ্রেণীর জোনাকি আবার দু’টি প্রজাতিতে বিভক্ত, ফোটিনাস পাইরালিস এবং ফোটিনাস ক্যারোলিনাস। গ্রাম-বাংলার চির পরিচিত জোনাকি হল এই ফোটিনাস পাইরালিস প্রজাতির। পৃথিবীতে এদের সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।), ক্রাটোমরফিনি, ফাউসিস, প্লিওটোমিনি (খুব বিরল প্রজাতির এই জোনাকি দের দু’টি প্রজাতি- প্লিওটোমাস প্যালেন্স এবং প্লিওটোমাস নিগ্রিক্যান্স), ল্যামপিরিনি, ফটুরিনা (এরাই সবচেয়ে বড় আকারে জোনাকি। এদের প্রজাতিগুলি হল- ফটুরিস, ফটুরিস ভারসিকোলোর, ফটুরিস ফ্রন্টেলিস), লুসিওলিনাই (এই শ্রেণীর জোনাকি দের পারিবারিক ভাগগুলি অন্য শ্রেণীর থেকে বেশি। যেমন- পিরোপটিক্স, লুসিওলা, লুসিওলা লুসিটালিকা), পোল্লাক্লাসিস, অটোটোট্টিনাই প্রভৃতি।
আলোর কারণ
এই পৃথিবীতে যত বিস্ময়কর পতঙ্গ আছে, জোনাকি তাদের অন্যতম। তাদের শরীর থেকে নির্গত হওয়া আলো তাদের এত বিস্ময়কর বানিয়েছে। তারা তাদের আলো সাধারণত একে অপরকে আকৃষ্ট করার সংকেত হিসাবে ব্যবহার করে। আলোর সংকেতের মাধ্যমে স্ত্রী জোনাকি মিলনের জন্যে তার পুরুষ সঙ্গীকে খুঁজে নেয়। দেখা গিয়েছে, পুরুষ জোনাকি র আলোর ঔজ্জ্বল্য তুলনামূলক বেশি, স্ত্রী জোনাকি তাদের প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট হয়। এছাড়া আলোর নানা রকম সংকেতের মাধ্যমে জোনাকিরা নিজেদের অবস্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ভাব বিনিময়, আত্মরক্ষা প্রভৃতি ক্রিয়া-কর্মগুলিও করে থাকে।
আলোর রহস্য
কিন্তু আলো সৃষ্টির রহস্য কিন্তু মোটেও নয়। অনেকেই তাদের আলো জ্বলার কারণ হিসাবে ফসফরাসের উপস্থিতি ভেবে থাকে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তাদের শরীরে ফসফরাসের পরিমাণ অতি সামান্য। যা দিয়ে আর যাইহোক, আলো জ্বলবে না। আসলে জোনাকি র পেটের নিচে বিশেষ ধরণের কিছু কোশে সংঘটিত এক প্রকার কেমিক্যাল রিয়েকশন এই আলো সৃষ্টির মূল কারণ। এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয় নির্দিষ্ট কিছু কোশের মাইট্রোকন্ড্রিয়ায়। প্রক্রিয়াটি দু’টি ধাপে ঘটতে দেখা যায় –
(১) কোশের মধ্যে “লুসিফেরিন” এবং “লুসিফেরাস” (এটি একটি এনজাইম) নামে দুই ধরণের রাসায়নিক পদার্থ জমা থাকে। লুসিফেরাসের উপস্থিতিতে লুসিফেরিন কোশের মধ্যে থাকা অ্যাডোনোসিস ট্রাইফসফেট (ATP)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে লুসিফেরাইল অ্যাডেনাইলেট এবং পাইরোফসফেট উৎপন্ন করে।
(২) এরপর লুসিফেরাইল অ্যাডেনাইলেট অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অক্সিলুসিফেরিন এবং অ্যাডনোসাইন মনোফসফেট (AMP) উৎপন্ন করে। আর এর থেকেই বেরিয়ে আসে আলো। বিক্রিয়ার শেষে অক্সিলুসিফেরিন ও AMP লুসিফেরাস থেকে মুক্ত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় “বাইওলুমিনেসেন্স” বলা হয়।
আলোর প্রকৃতি
এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার হয়। কোশের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি আলোর উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে। জোনাকি র আলো কিন্তু সারাক্ষণ স্থিরভাবে জ্বলে থাকে না (ফাউসিস রেটিকুলাটা প্রজাতির জোনাকি ছাড়া)। তার কারণ অক্সিজেনের সরবরাহ। বাইওলুমিনেসেন্সের সময় নির্দিষ্ট কোশের মধ্যে অক্সিজেন যখনই নালিকার মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখনই কেমিক্যাল রিয়েকশন শুরু হয় এবং আলো জ্বলে ওঠে। আর যখন অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন কেমিক্যাল রিয়েকশন না হওয়াতে আলোও নিভে যায়। এই ভাবেই জোনাকি রা রাতের অন্ধকার ভেদ করে সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে আলোর বন্যা বইয়ে দেয়।
কঠিন সঙ্কটে জোনাকি
তবে এই আলোর মায়াজাল আর হয়তো বেশি দিনের নয়। সমস্ত জোনাকি পরিবার এখন ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। বিশ্ব উষ্ণায়ণ ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু পরিবেশে টিকে থাকতে জোনাকিরা অত দ্রুত তাদের অভিব্যক্তি ঘটাতে পারছে না। তামাকজাত দ্রব্য, যানবাহন বা কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া (বিশেষ করে কার্বন মনো-অক্সাইড) জোনাকি দের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
জোনাকি রা গাছের ঝোপ-ঝাড় আর নির্জনতা একটু বেশিই ভালোবাসে। মনুষ্য সমাজের পরিধি বাড়াতে ঘন জঙ্গলগুলি কেটে ছোটো করে দেওয়া হচ্ছে, আর সেখানে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা। তাই নিজেদের প্রিয় বাসস্থান থেকে বিতারিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে জোনাকিরা। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের উপযুক্ত প্রজনন ব্যবস্থার পরিকাঠামো। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কোনও একদিন বই-এর পাতাতেই শুধু লেখা থাকবে “থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে”। কিন্তু বাস্তবে পরিবেশের খাতা হয়ে যাবে জোনাকি শূন্য।
সূত্র :
১. Firefly conservation & research (Online page)
২. Smithsonian Magazine
৩. Scientific American 175