বাংলার মানুষের কাছে কালো চাল প্রথম পছন্দের তালিকায় না থাকলেও বিদেশের বাজার বিশেষ করে ইউরোপ বা আরবিয় দেশগুলির বাজারে এই চালের কদর রয়েছে অনেক বেশি। তার প্রধান কারণ এই চালে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন এর উপস্থিতি। বাংলায় উৎপাদিত এই চালের বেশির ভাগটাই তাই রফতানি করা হয় ওই সমস্ত দেশে।

কথায় আছে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। তবে মাছ থাক বা না থাক, প্রতিদিনের খাবার পাতে ভাত অবশ্যই থাকবে। ভাত ছাড়া বাঙালি একেবারেই অসম্ভব! তাই তো বলে ‘ভেতো বাঙালি’।
বাঙালিরা এতদিন সাদা বা বাদামি রঙের চাল দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু ২০০৮ সাল নাগাদ ফুলিয়ায় যখন কালো ধান থেকে কালো চাল বেরিয়ে এল, তখন অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ‘কালো চাল আবার হয় নাকি?’ অনেকেরই প্রশ্ন ছিল এরকম। নতুন কিছু দেখার লোভে বহু মানুষ হামলে পড়েছিল ওই অঞ্চলের কৃষি দফতরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। পরে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে বর্ধমানে চাষ হতে শুরু হয় কালো ধানের।
চালের রঙ কালো। সেই চাল ফুটিয়ে ভাত হলে তার রঙ হয়ে যায় গাঢ় বেগুনী। ভাত থেকে বেশ মনোরম সুগন্ধ বের হয়। যদিও গাছের পাতা রঙ সবুজই থাকে। কিন্তু বিশেষ কয়েকটি জাতের কালো চাল –এর গাছের পাতার রঙ কিছুটা বেগুনীও হতে পারে।
বর্তমানে খোলা বাজারে কালো চাল –এর দাম স্থান ভেদে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা প্রতি কেজি। চাষের খরচ সাধারণ ধানের মতো হলেও দাম অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই। এবিষয়ে একাধিক চাষির মতে, স্থানীয় বাজারে কালো চাল –এর চাহিদা কম। তাই চাষিরা এই চাল উৎপাদনে তেমন আগ্রহ দেখান না। যেটুকু দাম তাঁরা পান, তার অধিকাংশই বাংলার বাইরের বাজারে চাহিদা থাকার দৌলতে। স্থানীয় বাজারে কালো চাল –এর চাহিদা বাড়লে চাষিরা চাষে উৎসাহ পাবে, সেই সঙ্গে চাষ বাড়লে চালের দামও কমবে।
সব মিলিয়ে এই রাজ্যে প্রতি বছর সাদা চালের উৎপাদন যেখানে গড়ে দেড় কোটি টনেরও বেশি। সে তুলনায় কালো চাল –এর উৎপাদন মাত্র ১৫ টন প্রায়।
বাংলায় কালো চাল –এর চাহিদা এত কম কেন? একাধিক বিশেষজ্ঞের ধারণা, এর প্রধান কারণ, ‘ভেতো বাঙালি’ সাদা ভাত খেতেই বেশি অভ্যস্ত। যুগ যুগ ধরে এই সাদা ভাতই তারা খেয়ে এসেছে। তার উপর ‘কালো’ রঙ অধিকাংশ বাঙালির কাছেই ‘অপছায়া’র মতো। তাই বাঙালিরা কালো ছেড়ে সাদা ভাতকেই পছন্দ করছে বেশি। এছাড়াও রয়েছে প্রচারের অভাব। কালো চাল –এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে এখনও তেমনভাবে মানুষ জেনে উঠতে পারেননি।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সাদা চালের তুলনায় কালো চাল –এ পুষ্টিগুণ অনেকটাই বেশি। এতে রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিনের বেশ কয়েকটি উপাদান। যার ফলে চালের রঙ হয় কালো আর ভাতের রঙ হয় গাঢ় বেগুনী। এই অ্যান্থোসায়ানিন মূলত একটি ক্যানসার প্রতিরোধী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। যা সাধারণ চালের থাকে না বললেই চলে। এর পাশাপাশি এতে রয়েছে অনেক বেশি ফাইবার। ফাইবার শরীরে গ্লুকোজ তৈরির গতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে যা বিশেষ উপযোগী। এছাড়াও ভিটামিন, জিঙ্ক সহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থে ভরপুর এই কালো চাল। যে কারণে পুষ্টিগুণে সাধারণ চাল অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে কালো চাল –এর কাছে।
তবে বাংলার মানুষের কাছে কালো চাল প্রথম পছন্দের তালিকায় না থাকলেও বিদেশের বাজার বিশেষ করে ইউরোপ বা আরবিয় দেশগুলির বাজারে এই চালের কদর রয়েছে অনেক বেশি। তার প্রধান কারণ এই চালে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন এর উপস্থিতি। বাংলায় উৎপাদিত এই চালের বেশির ভাগটাই তাই রফতানি করা হয় ওই সমস্ত দেশে।
তবে এই বঙ্গে সবচেয়ে বড় সমস্যা ধান থেকে চাল উৎপাদনে। কারণ সচরাচর যে মেশিনগুলি ব্যবহার করে ধান থেকে চাল উৎপাদন করা হয়, তাতে ধানের খোসা বা তুষের নিচে চালের গায়ে লেগে থাকা পাতলা আবরণ আলাদা হয়ে যায়। তাতে চালের মূল পুষ্টিগুণ প্রকৃতপক্ষে প্রায় পাওয়া যায় না। কালো চাল –এর ক্ষেত্রে সেই পাতলা আবরণেই রয়ে যায় অ্যান্থোসায়ানিন। তাই কালো চাল পাওয়া গেলেও তার পুষ্টিগুণ মূলত পাওয়াই যায় না।
এছাড়াও রাইসমিলগুলিতে আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য পালিশের ব্যবস্থা থাকে। তাতে যেটুকু পুষ্টিগুণ অবশিষ্ট থাকে, তাও বিনষ্ট হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে বিশেষ মেশিনের। যার মূল্য সাধারণ মেশিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করা গেলে কালো চাল –এর ভবিষ্যৎ বাংলার বাজারেও বেশ উজ্জ্বল।