একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, মধ্যযুগে বাংলার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ছিল কালাপাহাড়। বহু যুদ্ধের অক্লান্ত সেনাপতিও ছিল। বাংলার অসংখ্য গল্প-গাঁথার নায়ক বা খলনায়ক সে। তার জীবিতকালে কোনও ভাবেই মুঘলরা বাংলা মুলুকে প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু তার জীবনের শেষ পরিণতি কী ঘটেছিল তা আজও এক রহস্যে ঘেরা।

ষোল শতকের মধ্যবর্তী সময়। দিল্লীর সিংহাসনে তখন মুঘল সম্রাট আকবর বিরাজমান। বাংলা মুলুক তখনও দিল্লীর বশ্যতা স্বীকার করেনি। কারণ এখানে তখন এমন একজন সেনাপতি নিজের গড় পাহারা দিয়ে চলেছে তাকে টপকে এই মুলুকে প্রবেশ করা ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার। ইতিমধ্যেই বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলা বাদশাহ সুলায়মান খান কররানির বিশেষ অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হতে পেরেছে সেই সেনাপতি।
সেই বিশেষ সেনাপতি আর কেউ নয়, কালাপাহাড়। যদিও এটা ছিল তার উপাধি। কিন্তু এই একটি নাম শুনলেই যেন চরম কোনও এক হিন্দু বিদ্বেষী সেনাপতির প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কারণ বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী বহু অঞ্চলের কত শত মন্দির-মূর্তি তার তরবারির আঘাতে ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব সুনির্দিষ্টভাবে কোনও ইতিহাসে নেই। আধুনিক সময়েও বহু লেখকের কলমে কালাপাহাড় বারবার উঠে এসেছে বিভিন্নভাবে। গ্রামীণ অসংখ্য মিথ বা গল্প-গাঁথায় তার বর্বরতার ছবি আজও যেন জীবিত হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে কালাপাহাড় যেন ছিল এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। তা সত্ত্বেও কালাপাহাড় ছিল একজন দুঃসাহসী স্বাধীনচেতা সেনা নায়ক।
যদিও বর্তমান পূর্ব বঙ্গের রাজশাহী জেলার নওগাঁ অঞ্চলে সাধারণ একটি ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব পরিবারে কালাপাহাড় এর জন্ম হয়েছিল। তার পিতা নয়ানচাঁদ ছিল সেই সময়কার গৌড় বাদশাহের ফৌজদার। নিয়মিত বিষ্ণু পুজো করত সে। নিয়মিত বিষ্ণু পুজো করত কালাপাহাড় ও। যদিও সে সময়ে তার নাম কালাপাহাড় হয়ে ওঠেনি। তখনও সে ছিল একজন সাধারণ ব্রাহ্মণ সন্তান। তবে তার আসল নাম নিয়ে রয়েছে একাধিক বিতর্ক। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন, এই যেমন কালাচাঁদ, রাজচন্দ্র, রাজীব লোচন প্রভৃতি। তবে অনেকেই স্বীকার করেছেন ছোটবেলায় রাজু নামেই কালাপাহাড় বেশি পরিচিত ছিল।
একাধিক ঐতিহাসিকের দাবি, বাদশাহ সুলায়মান খান কররানির সেনাবাহিনীতে প্রবেশের পরই কালাপাহাড়ের জীবন পালটে যায়। সেই সময় বাদশাহ কন্যা দুলারি বিবির প্রেমে পড়ে সে (অনেকের মতে, দুলারি বিবি কালাপাহাড় এর প্রেমে পড়েছিল)। অগত্যা বিয়ের জন্য ধর্মান্তর হতে হয় তাকে। এই ধর্মান্তর অবশ্য সেই সময়কার হিন্দু সমাজ একেবারেই ভাল চোখে নেয়নি। হিন্দু সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হয় কালাপাহাড় কে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক জানাচ্ছেন, এরপরই কালাপাহাড় চরম হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। তখন সে একজন সাধারণ সেনাপতি থেকে হয়ে উঠেছে প্রধান সেনাপতি। একের পর এক হিন্দু মন্দির ও মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মণিমাণিক্য খচিত মূর্তিগুলি ধ্বংস হতে থাকে তার নির্দেশে।
তবে একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, মধ্যযুগে বাংলার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ছিল কালাপাহাড়। বহু যুদ্ধের অক্লান্ত সেনাপতিও ছিল। বাংলার অসংখ্য গল্প-গাঁথার নায়ক বা খলনায়ক সে। তার জীবিতকালে কোনও ভাবেই মুঘলরা বাংলা মুলুকে প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু তার জীবনের শেষ পরিণতি কী ঘটেছিল তা আজও এক রহস্যে ঘেরা। অনেকের দাবি, হিন্দু সমাজের অভিসম্পাতের কারণে তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু ঐতিহাসিকদের সামান্য কিছু সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, মুঘলদের সঙ্গে সংঘর্ষে সমর অভিযানের সময় ১৫৮৩ সাল নাগাদ কালাপাহাড় এর মৃত্যু ঘটে। তার সমাধি কোথায় দেওয়া হয়েছিল তার প্রকৃত খোঁজ অবশ্য আর কেউই পাননি। তবে অনেকের দাবি, ওড়িশার সম্বলপুরে মহানদীর কাছে কোনও এক স্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।