কার্বাইড এ পাকানো ফল শরীরের পক্ষে প্রচন্ড ক্ষতিকারক। এই ফল হার্ট, কিডনি, লিভার স্নায়ুতন্ত্র, ফুসফুস প্রভৃতি সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতি করে। তাছাড়া এই রাসায়নিকটি ক্যান্সারের কারণ বলে জানা গেছে। কার্বাইড এর কণা পেটে গেলে সরাসরি পাকস্থলীতে আলসার সৃষ্টি করে ও লিভারের কোষ নষ্ট করে থাকে। রক্তের লোহিত কণিকার অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বাস্তবিক কার্বাইড এত রকম স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ যে তা লিখে শেষ করা যাবে না।

যে কোনও মানুষের কাছে আমের অমোঘ আকর্ষণ এড়ানো খুব কঠিন। তার ওপর আম আমার সবচেয়ে প্রিয় ফল। সিউড়ি বাস স্ট্যান্ডে ফলের বাজারে আম কিনতে গিয়ে চমকে উঠলাম। আমের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ছোপ। আমজনতার গোয়েন্দাগিরি আর কি! ভেতরকার ‘ফেলুদা’ চনমন করে উঠল। দোকানদারকে বললাম, ‘একি, এতো কার্বাইড এ পাকানো আম! তুমি এইভাবে বিক্রি করছ।’ দোকানদার অম্লান বদনে বলল, ‘সব আমই তো দাদা কার্বাইড এ পাকানো। এমনি আম থোড়ি পাওয়া যায়। তাছাড়া কার্বাইড এমন কিছু খারাপ জিনিস নয়। কোনও কেমিক্যাল হলে কথা ছিল। কার্বাইড দেওয়া হয় গরম করার জন্য, যাতে গরমে আমটা ভালোভাবে পাকে। ফলে কত রকম ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহার হয় জানেন! এখানে তো সে সব কিছুই ব্যবহার হয় না। কার্বাইড দেখতে গেলে আর আম খেতে হবে না।’
কার্বাইড কেমিক্যাল নয় শুনে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হবে সেটা জানি। এখন ফল পাকানোর জন্য (আম, পেঁপে, কলা, কমলালেবু, সবেদা, খেজুর, টমেটো প্রভৃতি) ক্যালসিয়াম কার্বাইডের (Cac2) কারবার বহুল প্রচলিত। সাধারণভাবে এই রাসায়নিকটি ঝালাই এর জন্য অ্যাসিটিলিন গ্যাস উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়। মানুষ এবং যে কোনও প্রাণীর জন্য তা প্রচন্ড ক্ষতিকারক হওয়ায় ১৯৫৫ (PFA rules) সাল থেকেই ফল পাকানো বা খাদ্যে এর ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে খাদ্য সুরক্ষা আইন ও ২০১১ সালের আইনে খাদ্যে এই রাসায়নিকের ব্যবহারকে অপরাধমূলক কার্যকলাপ রূপে বর্ণনা করে এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও ছয় মাসের জন্য কারাদণ্ডের কঠোর সংস্থান রাখা হয়েছে।
বর্তমানে বিশেষ করে আমের মরশুমে ফোড়েরা ফল চাষীদের কাছ থেকে পুরো গাছ ও বাগান অগ্রিম টাকা দিয়ে জমা নিয়ে নেয়। এরপর আম মোটামুটি বিক্রয় যোগ্য আকার ধারণ করলেই তা কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা হয়। এতে আম কম নষ্ট হয় এবং লাভ হয় অনেক বেশি। কিন্তু এই আম কয়েকদিন রেখে দিলে তা পচে বা শুকিয়ে গেলেও কখনওই পাকবে না। এখান থেকেই শুরু হয় খেলা।
আমপাড়া থেকে খুচরা ব্যবসায়ীর হাতে আসতে ন্যূনতম তিন দিন সময় লাগে। এই সময় আমগুলিকে দ্রুত পাকানোর জন্য ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগ করা হয়। এই কার্বাইড জলের সাথে বিক্রিয়ায় অ্যাসিটিলিন গ্যাস উৎপন্ন করে যা অনেকটা ফল পাকানোর প্রাকৃতিক হরমোন ইথিলিনের মতো কাজ করে, CaC2+2H2O = C2H2+Ca(OH)2। ফলগুলিতে দ্রুত পাকার মতো রং ধরে যায় এবং লুব্ধ ক্রেতা গাছপাকা আমের লোভে প্রকৃতপক্ষে মারাত্মক বিষ ফল বহু মূল্যে কিনে নিয়ে যান।
স্বাভাবিকভাবে ফল পাকলে তার যে গুণমান থাকে, কার্বাইড এ পাকানো ফলে তা থাকে না। প্রকৃতপক্ষে ফলটি পাকেই না, পাকার রূপ ধারণ করে মাত্র। কার্বাইড এ পাকানো ফল স্বাদে গন্ধে কখনওই কোনও প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলের সমতুল্য নয়।
কার্বাইড এ পাকানো ফল শরীরের পক্ষে প্রচন্ড ক্ষতিকারক। এই ফল হার্ট, কিডনি, লিভার স্নায়ুতন্ত্র, ফুসফুস প্রভৃতি সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতি করে। তাছাড়া এই রাসায়নিকটি ক্যান্সারের কারণ বলে জানা গেছে। কার্বাইড এর কণা পেটে গেলে সরাসরি পাকস্থলীতে আলসার সৃষ্টি করে ও লিভারের কোষ নষ্ট করে থাকে। রক্তের লোহিত কণিকার অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বাস্তবিক কার্বাইড এত রকম স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ যে তা লিখে শেষ করা যাবে না।
ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মধ্যে আর্সেনিক ও ফসফরাস হাইড্রাইডের মত ক্ষতিকারক রাসায়নিকের অবশেষ থেকে যায়, যা শরীরে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে।
অত্যধিক মাত্রায় শরীরে ফলের সঙ্গে কার্বাইড প্রবেশ করলে (যা এখন অত্যধিক মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে) বমি, ডায়রিয়া, ড্রাউজিনেস, কাশি, বুক জ্বালা, দুর্বলতা, নিদ্রাহীনতা, ডিপ্রেশন, মানসিক সমস্যা, মেমোরি লস, গলায় ইরিটেশন (খাবার সময়) চোখে ও ত্বকে প্রদাহ, চোখ নষ্ট হওয়া, মস্তিষ্কে জল জমা (সেরিব্রাল ইডিমা) ফুসফুসে জল জমা (পালমোনারি ইডিমা) প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বাঁচার উপায় কী?
১. টাটকা ফল পেতে বাড়িতে বা এলাকায় আরও ফলের গাছ লাগান। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হওয়া ফল কিনুন।
২. ফল কেনার সময় ফেলুদার মত পরীক্ষা করুন, দেখুন সেখানে সাদা বা ছাই রঙের ছোপ আছে কিনা। থাকলে সেই ফল না কেনাই বাঞ্ছনীয়।
৩. ফলের গন্ধ শুঁকে দেখুন। স্বাভাবিক লাগলে কিনতে পারেন।
৪. কার্বাইড এ পাকানো ফলে সমানভাবে পাকার রং লাগে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে পাকা ফলের কোনও কোনও অংশ সবুজ থাকে। তাছাড়া ফল পাকার মিষ্টি গন্ধও পাওয়া যায়।
৫. কার্বাইড -এর পাকানো ফলের ত্বকে স্বাভাবিকতা থাকেনা। কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব থাকে।
৬. স্বাভাবিকভাবে পাকা ফল কয়েকদিন রাখা যায়। কিন্তু কার্বাইড এ পাকানো ফল অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যায় ও কালো ছোপ ধরে।
৭.কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল কখনও সরাসরি বিক্রেতার কাছ থেকে খেয়ে দেখা বিপদজনক।
অতএব, বাজার থেকে ফল কিনে আনার পর তা প্রচুর জল দিয়ে ভালো করে রোগড়ে ধুতে হবে। পরে ভালো জলে তা দীর্ঘক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে। পারলে গোটা ফল খাওয়ার চেয়ে ফলের খোসা ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো করে খান এতে ক্ষতি কম হবে।
আমাদের দেশে কড়া আইন থাকলেও জনসাধারণের ঔদাসীন্য ও সরকারি নজরদারি ব্যবস্থার অপ্রতুলতার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থায় সঠিক জানকারি একমাত্র বাঁচার উপায়। কে বলতে পারে আপনার কোনও স্বাস্থ্য সমস্যার পেছনে রয়েছে এই বিষাক্ত ফল!