কীভাবে এলিজাবেথ বাথোরি তাঁর শিকারকে অত্যাচার করে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিত, তা টর্চার রুমে উপস্থিত কর্মচারীরা সাক্ষী দিয়ে গিয়েছে তদন্তকারী জুরাজ তুরযোকে। শিকারকে প্রথমে গরম লোহার ছ্যাঁকা দেওয়া হত। তারপর অত্যন্ত পেটানো হত। পরেতাদের নখের তলায় সূঁচ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। শিকার যখন প্রায় মৃত, তাদের গলা কেটে সমস্ত রক্ত বের করে বাথটাবে রাখা হত।

১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ব্রাম স্টকারের ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি ছিল সেসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম। সম্পূর্ণ আলাদা স্বাদের কল্পকাহিনী দিয়ে সাজানো এই বইটিতে ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষকের জগতকে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে মানুষের তাজা রক্ত ছিল যার একমাত্র আহার। অনেকেই ধারণা করেন, সেই বিখ্যাত উপন্যাসটি এলিজাবেথ বাথোরি নামে এক ভয়ঙ্কর বা কুখ্যাত সুন্দরীর জীবনকাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত।
এলিজাবেথ বাথোরি –কে অনেক ঐতিহাসিক পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার বলে আখ্যায়িত করেছেন। জনশ্রুতি আছে, সে ৬৫০ জন কুমারী মেয়েকে হত্যা করে তাদের রক্তে স্নান করেছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ এলিজাবেথ বাথোরি -র ভয়ে তাদের কন্যাসন্তানদের লুকিয়ে লুকিয়ে পর্যন্ত রাখতে শুরু করেছিল। তার ভয়ঙ্কর সব কর্মকান্ডের জন্যই ইতিহাস তার নাম দিয়েছে “দ্য ব্লাড কাউন্টেস”।
এলিজাবেথ বাথোরি –র বিকৃত মস্তিষ্কের জন্ম
হাঙ্গেরির এক ক্ষমতাশালী প্রটেস্টাইন খ্রিস্টান পরিবারে ১৫৬০ সালের ৭ আগস্ট এলিজাবেথ বাথোরি -র জন্ম হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা, তাঁর কুখ্যাত হয়ে ওঠার ভিত আসলে গড়ে উঠেছিল ছেলেবেলাতেই। কারণ তাঁর বাড়ির পরিবেশ ছিল কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন। অতিসাধারণ ভুল-ভ্রান্তিতেও কর্মচারীদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হত। তার উপর এলিজাবেথ বাথোরি –র পিসি ছিলেন একজন স্যাডোম্যাসোকিস্ট আর কাকা শয়তানের পূজারি।
এই সমস্ত কারণে ধারণা করা হয়, এলিজাবেথ বাথোরি মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর মৃগী রোগ ছিল। বারবার ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন। এই রকম পরিস্থিতিতে মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয় ফেরেন্স নাদাসদির সঙ্গে। যিনি ছিলেন হাঙ্গেরির একজন সেনা প্রধান। তিনিও ছিলেন একজন ভয়ঙ্কর অত্যাচারী। অর্থাৎ স্বামীর সংসারে এসেও এলিজাবেথ বাথোরি নিষ্ঠুর আর অত্যাচার পরিবেশই পেয়েছিলেন। ফলে তিনি কখনওই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি। বরং এই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে তিনি নিজেকেও গড়ে তুলেছেন ভয়ঙ্কর নারীতে।
রক্তের মাঝে সৌন্দর্য
হাঙ্গেরিতে এখনও একটি জনশ্রুতি রয়েছে। একদিন এলিজাবেথ বাথোরি সাঁজতে বসেছেন। চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন এক সেবিকা। কোনওভাবে চুলে একটু বেশি টান পড়ে যায়। এলিজাবেথ প্রচন্ড রেগে সেবিকার মুখে আঘাত করে বসেন। তাতে সেবিকার নাক ফেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। আর সেই রক্তের কিছু অংশ অজ্ঞাতে এলিজাবেথ বাথোরি –র হাতে লেগে যায়।
ঘটনার সময়ে না দেখলেও পরে সেই রক্তের চিহ্ন তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু তখন রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া সেই রক্ত ধুয়ে ফেলতেই তাঁর ওই অংশের চামড়া হয়ে যায় মসৃণ আর উজ্জ্বল, ঠিক যেমনটি ছিল যৌবনকালের। আগাগোড়া কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এলিজাবেথ বাথোরি –র তখন ধারণা হয়েছিল, রক্তের মধ্যেই তাহলে চিরযৌবনের বীজ লুকিয়ে রয়েছে। শোনা যায়, এই ঘটনার পর থেকেই নাকি এলিজাবেথ বাথোরি রক্ত পিপাসু হয়ে ওঠেন।
কুমারী মেয়েরা রহস্য জনক ভাবে নিখোঁজ
স্বামীর মৃত্যুর পর এলিজাবেথ বাথোরি চলে আসেন নর্থওয়েস্ট হাঙ্গেরির (বর্তমানে স্লোভাকিয়া) ক্যাশতেকি দুর্গে। এখানে বসবাস শুরু করার পর থেকেই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির কুমারী মেয়েরা হঠাৎ করেই একে একে নিঁখোজ হতে শুরু হয়। ঘটনার প্রথম দিকে, দুর্গে কাজ করতে যাওয়া মেয়েরা নিখোঁজ হতে শুরু হল। পর্যবেক্ষণে দেখা গেল, যেসব কুমারী মেয়ে একবার দুর্গে কাজ করতে যেত, তারা আর কেউ ফিরে আসতে পারত না। তাদের পরিবারের লোকেরা অনুসন্ধানের চেষ্টা করলে তারা অত্যাচারিত হয়ে ফিরে আসত। এই নিখোঁজ হওয়ার প্রকৃত কারণ যে কি ছিল তা দীর্ঘদিন ধরেই ছিল অজ্ঞাত।
নিখোঁজ হওয়ার রহস্য সমাধান
এই নিখোঁজ হওয়ার রহস্য একদিন ফাঁস করে দিলেন ওই দুর্গের-ই কর্মরত একজন বয়স্কা সেবিকা। তিনি খুবই গোপনে গ্রামবাসীদের কাছে বার্তা পাঠালেন, তারা যেন তাদের কোনও কুমারী মেয়েকে দুর্গে না পাঠায়। কারণ ততদিনে এলিজাবেথ বাথোরি হয়ে উঠেছেন একজন ভয়ঙ্কর রক্ত পিপাসু। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে এক এক করে কুমারী মেয়েদের তিনি হত্যা করছেন, আর তাদের তাজা রক্ত গায়ে মেখে স্নান করছেন নিজের চিরযৌবন ধরে রাখার জন্য। গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের কুমারী মেয়েদের আর দুর্গে পাঠাতে চায়ত না। এমনকি তাদের মেয়েদের দূরে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত।
প্রশাসন নড়েচড়ে বসল
আশেপাশের গ্রামগুলির কুমারী মেয়ে তখন প্রায় কমে এসেছে। অনেক খুঁজেও গরীব ঘরের মেয়েদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এলিজাবেথ বাথোরি থেমে থাকবেন কেন। তখন তিনি ভয়ঙ্কর এক ড্রাকুলা। তাঁর নজর পড়ল ধনী ঘরের মেয়েদের দিকে। তাদের বেশ কয়েকজনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দুর্গে ডেকে এনে একই কর্মযজ্ঞ চালাতে লাগলেন। কিন্তু এবার টনক নড়ল প্রশাসনের। কারণ ধনী পরিবারের মেয়েরা নিখোঁজ হলে তার পূর্ণ তদন্ত হওয়া ছিল বাঞ্ছিনিয়। এমনকি ঘটনাটি ঘটনাটি রাজা দ্বিতীয় মায়াথাসের কানে পর্যন্ত যায়।
শুরু হয় তদন্ত। দেখা যায় যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই শেষ গন্তব্য ছিল এলিজাবেথ বাথোরি –র দুর্গ। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও অভিযোগ আনাও সমীচীন নয়। কারণ এলিজাবেথ এবং তাঁর পরিবারের বহু আত্মীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অতএব তদন্তকারীরা শুরু করলেন প্রমাণ যোগাড়ের কাজ।
এলিজাবেথ বাথোরি গ্রেফতার
তদন্তের কাজে নিযুক্ত করা হল জুরাজ তুরযোকে। যিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও ক্ষুরধার মস্তিষ্কের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বহু তদন্তের পর তিনি জানতেন পারলেন, ওই দুর্গে যেসব মেয়েরা একবার প্রবেশ করে তারা কেউই আর ফিরে আসে না। এবং নিখোঁজদের সবাই কুমারী। অর্থাৎ ওই দুর্গেই লুকিয়ে রয়েছে নিখোঁজের মূল সূত্র। এই তদন্তে তাঁকে অত্যন্ত সহযোগিতা করেছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গ্রামবাসীরা। নিখোঁজ হওয়া পরিবারের প্রত্যেকেই সাক্ষী দেওয়া শুরু করে।
একদিন চলে আসে সেই সুযোগ। এলিজাবেথ বাথোরি তখন তাঁর টর্চার রুমে কোনও এক কুমারী মেয়েকে হত্যা করতে ব্যস্ত। জুরাজ অতি সন্তর্পণে সেখানে উপস্থিত হয়ে এলিজাবেথ বাথোরি –কে হাতেনাতে গ্রেফফতার করেন। তারপর বেরিয়ে আসে তাঁর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
হত্যাযজ্ঞের নমুনা
কীভাবে এলিজাবেথ বাথোরি তাঁর শিকারকে অত্যাচার করে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিত, তা টর্চার রুমে উপস্থিত কর্মচারীরা সাক্ষী দিয়ে গিয়েছে তদন্তকারী জুরাজ তুরযোকে। শিকারকে প্রথমে গরম লোহার ছ্যাঁকা দেওয়া হত। তারপর অত্যন্ত পেটানো হত। পরে তাদের নখের তলায় সূঁচ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। শিকার যখন প্রায় মৃত, তাদের গলা কেটে সমস্ত রক্ত বের করে বাথটাবে রাখা হত। আর সেই রক্তে স্নান করতেন এলিজাবেথ বাথোরি। এমনকি এও শোনা যায়, অনেক সময় শিকারের ঘাড় কামড়ে তার রক্তও পান করতেন তিনি।
এলিজাবেথ বাথোরি –র সাজা
প্রমাণ ও সাক্ষীদের বয়ানে এলিজাবেথ বাথোরি –র নামে মোট ৮০ জন কুমারী মেয়ে হত্যার অভিযোগ আনা হয় আদালতে। যদিও তিনি হত্যা করেছিলেন আরও অসংখ্য কুমারী মেয়েকে। তবে বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। তার পরিবর্তে তাঁকে ক্যাশতেকি দুর্গের একটি ছোট কক্ষে আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সেই ঘরে কোনও আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা ছিল না। শুধু একটি মাত্র ছিদ্র ছিল, যা দিয়ে একবেলা খাবার পাঠানো হত তাঁর কক্ষে। এখানে চার বছর বন্দী থেকে তিনি ১৬১৪ সালের ২১ আগস্ট মারা যান।
সত্যি নাকি মিথ
ইউরোপে মধ্যযুগকে অনেক ঐতিহাসিকই বলেছেন ‘অন্ধকার যুগ’। বহু ঘটনাই সেযুগে মিথ বলে ধরে নেওয়া হত। যার সঙ্গে বাস্তবের মিল ছিল কম। এযুগে সাধারণ মানুষের মধ্যে কুসংস্কারের ছড়াছড়ি ছিল। তাই কোনও ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করতে বেগও পেতে হত না এই যুগে। এখানে এলিজাবেথ বাথোরি –র ঘটনাটিকেও অনেকে কল্পকাহিনী বলেও মনে করেন। অনেকে আবার ষড়যন্ত্রের শিকার বলেও দাবি করেন। তাঁদের দাবি, এলিজাবেথ বাথোরি ইস্তভান ম্যাগারি নামের এক পাদ্রির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। পাদ্রি কোনও কারণে এলিজাবেথ বাথোরি –কে পছন্দ করতেন না।
তিনি যে আদৌ কোনও রক্ত পিপাসু মহিলা ছিলেন, এমন কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ সরাসরি পাওয়া যায়নি। তার হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটিরও সরাসরি কোনও প্রমাণ নেই। অনেকেই বলেন, এলিজাবেথ বাথোরি –র একটি ডায়েরি ছিল, যেখানে ৩৫০ জন কুমারী মেয়ের নাম লেখা ছিল, যাঁদের তিনি হত্যা করেছিলেন। সেই ডায়েরিরও কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।