১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করবে– জাতিসংঘে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়েছিল।

বঙ্গ সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সুত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে।
ওই দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাঁদের উপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র-যুবা হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের জন্য অনুষ্ঠিত গেয়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষা শহিদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়।
২১ ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাশ হয়। যা কার্যকর হয় ওই বছরের ৮ মার্চ থেকে।
কানাডার ভ্যাঙ্কুকার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করবে– জাতিসংঘে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়েছিল।
মাতৃভাষা বিশেষ কোনও ব্যক্তি-মানুষের যেমন অন্যতম পরিচয়-উৎস, তেমনি তা একটি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বেরও শ্রেষ্ঠ স্মারক। মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতোই প্রিয়, মাতৃভাষা তার অন্যতম। বস্তুত মাতৃভাষাই একজন মানুষের পরিচয়ের শ্রেষ্ঠতম উৎস। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিশেষ কোনও মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে, তুলে ধরে তার জাতিসত্ত্বার পরিচয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনও জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। পারে না নিজের পরিচয়কে পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে। এমন ধারণা সর্ব জনস্বীকৃত।