এখন তো আন্তর্জাতিক নারী দিসব পালন করা হয় বেশ ঘটা করেই। পুরুষ সমাজসেবীরাও মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুবক্তা সেজে নারী কল্যাণের গালভরা প্রতিশ্রুতি আওড়ে যান। অথচ নারীরা তাঁদের প্রকৃত কল্যাণ, উপযুক্ত সম্মান, পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার কবে পাবে, আজকের দিনে সেটাই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন।

দিনটি ছিল ১৮৫৭ সালের ৭ মার্চ। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল একদল মহিলা বস্ত্রশ্রমিক। তাঁদের মূল বক্তব্য ছিল বেশ কয়েকটি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ১০ ঘণ্টা কাজ, কাজের অমানবিক পরিবেশ থেকে মুক্তি, মজুরির বৈষম্য বন্ধ করা প্রভৃতি। তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালালেও সরকারের পুলিশ বাহিনী চুপ করে বসে ছিল না সেদিন। তাঁদের উপর চালিয়েছিল অমানবিক অত্যাচার। ইতিহাসে এটি ছিল অন্যতম বৃহৎ নারী আন্দোলন।
এর প্রায় ৫২ বছর পর ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আবারও নিউইয়র্ক শহরে জামায়েত হয়েছিল নারী শক্তি। নারীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরতে এই সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন তারা। এদিনের সমাবেশে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। এই সমাবেশকে ধরা হয় ইতিহাসের প্রথম নারী সমাবেশ। দ্বিতীয় সমাবেশটি ঘটেছিল ঠিক এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে। ওদিনের সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে যোগদান করতে এগিয়ে এসেছিল ১৭টি দেশের প্রায় ১০০ জন প্রতিনিধি। এরা প্রত্যেকেই ছিল মহিলা। নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন এই সম্মেলনে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালন করার। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ১৯১১ সাল থেকেই এই নারী দিবস পালন করা হবে।
তারপর থেকে ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধাপে ধাপে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করে। এর অনেক পরে ১৯৭৫ সালে জাতিসঙ্ঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক রূপে পালন করার স্বীকৃতি দেয়। যা এখন সমগ্র বিশ্ব জুড়েই ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। (সূত্র : বাংলা উইকিপিডিয়া)
এখন ২০২০। সারা পৃথিবী সমস্ত দিক থেকে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। মহিলাদের উপযুক্ত সম্মান জানাতেও সারা বিশ্ব এখন তৎপর। কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতই কী মহিলারা উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছেন? পুরুষেরা কি নারীদের হাতে প্রকৃতই পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দিতে চাইছে? এখানে কিন্তু ‘না’-এর দিকেই পাল্লা ভারি হয়ে যাচ্ছে। সমাজের দিকে একটু নিখুঁতভাবে নজর রাখলে দেখতে পাওয়া যাবে, পুরুষ এখনও তাঁর ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’ ছাড়তে পারেনি। সে বল প্রয়োগ করেই হোক, আর আইনের ফাঁক গলেই হোক, নিজের ক্ষমতা ঠিক আগের মতোই কায়েম রেখেছে বা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তবু পুরুষেরা মহিলাদের প্রতি একটু বিশ্বাস রাখলে ক্ষতি কি। হতে পারে নারীরা পুরুষের তুলনায় দৈহিক শক্তির দিক থেকে দুর্বল। কিন্তু দৈহিক শক্তিই কী আসল শক্তি? বর্তমান বিশ্বের নারীরা যাঁরা একটু সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা কিন্তু তাঁদের জাত চেনাতে ভোলেননি। সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প, ক্রীড়া, রাজনীতি সমস্ত দিক থেকেই ছাপিয়ে গিয়েছেন পুরুষের থেকে। এমনকি তাঁরা এখন পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহাকাশেও পাড়ি দিচ্ছেন।
তবুও সমাজের এক শ্রেণীর নিন্দুক পুরুষ তাঁদের হেয় করতে পিছু ছাড়ে না। ঘরের দরজা বন্ধ রেখে আটকে রাখতে চায় নারী সমাজকে। নারীরা কখন কি করবে, কি পড়বে, কোথায় যাবে, কার সাথে চলাফেরা করবে, এরকম সমস্ত কিছুই নির্ধারণ করে দেয় ওই শ্রেণীর পুরুষেরা। তারা আজও যেন নারীকে নিজেদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চায় না। অথচ মজার ব্যাপার, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আইন অনুযায়ী নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে।
এবার যদি নিজেদের ঘরের দিকে নজর দেওয়া হয়, দেখা যাবে নারী ছাড়া সংসার একেবারেই অচল। সংসারে পুরুষ জাতি অর্থ উপার্জনে নিজেকে সব সময়ই ব্যস্ত রাখে। ঘরের ভেতরের খবর সে বিশেষ রাখার প্রয়োজন মনে করে না। তাকে দিনের অধিকাংশ সময়ই বাইরে ব্যয় করতে হয়। অথচ কি সুন্দর সাজানো-গোছানো থাকে সংসার। এখানেই কৃতিত্ব দিতে হবে নারীকে। কর্তা বাড়ির বাইরে পা রাখলেই তার যেন দশ হাত গজিয়ে ওঠে। সংসার ছোটো হোক বা বড়ো, তাকেই প্রতিদিনের সমস্ত কাজ ঠিক সময় মতো করতে হয়। শারীরিক অসুস্থতাও তাকে প্রকাশ করলে চলে না। সে পুরুষের মতো জবাবদিহি চায় না। তার যত রাগ-ক্ষোভ-অভিমান সব কিছুই চাপা থাকে মনের গভীরে। এসব যেন প্রকাশ করার তার কোনও অধিকার নেই।
এত কিছুর পরেও পুরুষের কাছে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ এই সমাজে কন্যা সন্তান হয়ে জন্মানো যেন এক আদিম অভিশাপ। এমনকি ভারতের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বা ব্যাডমিন্টন তারকা সাইনা নেওয়াল জন্মানোর পরপরই তাঁদের কপালে জুটেছিল একরাশ অবজ্ঞা। সাইনা মেয়ে হয়ে জন্মিয়েছে বলে তাঁর ঠাকুমা দীর্ঘদিন তাঁর সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি। শুধু অবজ্ঞার চোখেই দেখে গিয়েছে। বর্তমান সমাজের চোখে নারীরা কতটা অবজ্ঞার তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মেলে কন্যাভ্রূণ হত্যায়। এই হত্যা সমাজের শিক্ষিত মুখোশধারী একদল ডাক্তারের দ্বারাই হয়ে থাকে। ভারতের প্রতি প্রান্তে এখনও গোপনে হয়ে চলেছে এই জঘন্যতম কাজ। অথচ আজ এই ভারতের নারীরাই বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ময়দানে ফাইনালের প্রস্তুতি পর্বে দেশের তেরঙ্গা উড়িয়ে চলেছে।
তবে একদিন এদের হয়েই লড়তে এগিয়ে এসেছিলেন এই ভারতেরই একদল কালজয়ী মনিষী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে লড়ে গিয়েছেন নারীদের হয়ে। তাঁরা বহু রকমভাবে এই সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। সফল যে হয়নি, তা নয়। অথচ আজও অধিকাংশ কুসংস্কার টিকে আছে শুধুমাত্র নারী সমাজকে দমিয়ে রাখতে।
জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এদেশে এখনও ৩৭ শতাংশ বিবাহিত মহিলা স্বামীর দ্বারা জোরপূর্বক যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ৪০ শতাংশ মহিলা শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে নারী পাচার, অ্যাসিড হামলা, যৌন হয়রানি, অপহরণ, খুন প্রভৃতি। তবে এসবের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা অবশ্যই আছে। কিন্তু সুব্যবস্থা পাচ্ছে কতজন।
এখন তো আন্তর্জাতিক নারী দিসব পালন করা হয় বেশ ঘটা করেই। পুরুষ সমাজসেবীরাও মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুবক্তা সেজে নারী কল্যাণের গালভরা প্রতিশ্রুতি আওড়ে যান। অথচ নারীরা তাঁদের প্রকৃত কল্যাণ, উপযুক্ত সম্মান, পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার কবে পাবে, আজকের দিনে সেটাই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন।